Wednesday, February 20, 2019

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে






"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়, একদম নয়। ওরা চব্বিশ ঘন্টা ভুল বোঝায়, চব্বিশ ঘন্টা বিপরীত কথা বলে। এই বলছে, আলোচনা করবে। এই বলছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে, কিন্তু হেলিকপ্টারে বন্দুক থাকবে। আবার বলছে, না, যদি নিচু থেকে গুলি ছোঁড়ে তা হলে বন্দুক থাকবে। এয়ারওয়াইজ মার্শাল বলছে, আড়াইশো পাউন্ডের বোমা মারব না, মারলে পাশের তিন-চারটা গ্রামের লোক মারা যাবে। ভাবুন, কত রকমের বিপরীতধর্মী কথা। আপনারা খুঁজুন, তথ্যের একেবারে টনটন হয়ে গেছে। এই সমস্ত কিছুর আবর্তে পড়ে আমরা একদম দিশেহারা। এই দিশেহারা মানুষের জন্যে কী দরকার? দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন মদের দোকান দরকার, সে রকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার। সোপ ওপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্লু-ফিল্ম দরকার। এগুলোর অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।
এই রকম করে আমাদের সমাজটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দের ইমপোর্ট ঘটিয়ে ব্যাপারটিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চিরদিন, বাংলায় বুদ্ধিজীবীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। রবীন্দ্রনাথ সিভিল সোসাইটি শব্দটা জানতেন না, জানার দরকার হয়নি। যখন দরকার ছিল, প্রতিবাদ করেছেন। আজকে হঠাৎ অ্যাংলো-অ্যামেরিকান কনোটেশনের একটা শব্দকে এখানে এনে—‘আমরা কি সত্যিই সিভিল সোসাইটি ?’ আরে ঘ্যাঁচুকলা, আমার কী দরকার সিভিল সোসাইটি হওয়ার? আমি আমার দেশের মানুষ, যে-ভাবে আমি ফিল করি, আমি বলব। আমরা কি সর্বক্ষেত্রে ওয়েস্টকে কপি করতে পারি? সিভিল সোসাইটি কী? সিভিল সোসাইটি, পশ্চিমি সংজ্ঞায় হচ্ছে, পারিবারিক স্যাংটিটির আলাদা জগৎ সেইটা এবং স্টেটের অফিসিয়াল জগৎ, এদের মধ্যে যারা থাকে। ঠিক আছে, ভাল কথা, আমাদের দেশে কি ভার্বেটিম সেগুলো হয়? আপনাদের কি মনে হচ্ছে, এই পরিবর্তনকামী এবং পরিবর্তনবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের দেখে, এদের ওপর সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব দেওয়া উচিত, না কি যায়? আপনারা এটা নিয়ে ভাবুন।

...কাজেই আজকে যে বড় লড়াইটার কথা কেউ-কেউ বলছেন, যে বড় লড়াইটা আমরা স্বপ্নে দেখি, সেই লড়াইটাকে মনে রাখতে হবে। ওয়ার্কিং ক্লাস একটা বড় রোল প্লে করবে, এবং তাতে এই যে গরিব— সে গ্রামের গরিব হোক, আর শহরের গরিব হোক— সবাই তার সঙ্গে যুক্ত হবে। তার সঙ্গে দরিদ্র কৃষক যুক্ত হবে, শহরের মধ্যবিত্ত যুক্ত হবে, এবং সেই দিন আসছে। সেই দিন, যে-দিন প্রত্যেকে আলাদা-আলাদা করে কোনো সুড়সুড়ির মজা পাবে না, যে-দিন প্রত্যেকের পিঠে একটা গরম ইস্ত্রি এসে পড়বে। সে দিনটা খুব দূরে নয়। এই চালের দাম বোধ হয় পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা হলেই বোঝা যাবে এটা কী দাঁড়ায়! এবং মনে রাখবেন, এই ঘটনা ব্রাজিলে হয়েছে, চিলিতে হয়েছে, আর্জেন্টিনায় হয়েছে, হাইতিতে হয়েছে, উরুগুয়েতে হয়েছে, গুয়াতেমালাতে হয়েছে। একটা দেশে পারেনি, খুব ভালো ভাবে করতে, নিকারাগুয়াতে। সেখানে একটু পিছু হটতে হয়েছে। ভেনেজুয়েলাতেও পারছে না। আর, কিউবাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই, আমাদের পক্ষেও তথ্য নেই, ইতিহাস নেই, রশদ নেই— এ রকম নয়। অনেক বেশি সাবধান হয়ে, অনেক আটঘাট বেঁধে আমাদের সামনের দিনটার কথা ভাবা উচিত। এই লড়াইটাকে কোনো মতে অর্থনীতিবাদের মধ্যে আটকে রাখলে হবে না। চে গ্যেভারা একটা কথা বলেছিলেন, আমার খুব ভাল লাগে এ কথাটা। বলেছিলেন, মানুষকে খাওয়ানো-পরানোটা যদি একমাত্র সমস্যা হয়, তা হলে একটা ইন্টেলিজেন্ট ফর্ম অফ নিও-ক্যাপিটালিজম ক্যান ডু ইট! এরা ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে, দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য নতুন মানুষ তৈরি করা, যে-মানুষ অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে। তা না হলে, মানুষ হয়ে বেঁচে কোনো লাভ নেই।"

- নবারুণ ভট্টাচার্য, ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনিলয়ে, ‘বিশ্বায়ন ও সন্ত্রাসবাদ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ‘মেদিনীপুর লেখক শিল্পী সমন্বয় মঞ্চ’। সেই সভায়, নবারুণ ভট্টাচার্য এই বক্তব্য রেখেছিলেন। সৌজন্যে ভাষাবন্ধন পত্রিকা। 



সম্পাদকমণ্ডলী-- হিন্দোল ভট্টাচার্য, সন্দীপন চক্রবর্তী, মণিশংকর বিশ্বাস বেবী সাউ শমীক ঘোষ
ঠিকানা- সি ৩/৬ কালিন্দী হাউসিং এস্টেট, কলকাতা-৮৯
লেখা পাঠানোর ইমেল আইডি-  abahaman.magazine@gmail.com 



২১শের দীপ জ্বালাও: অমর মিত্র


                    
                  ২১শের দীপ জ্বালাও

   আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমার মাতৃভাষা বাংলা, আমি বলব সমস্ত মাতৃভাষার  কথা। আমি বলব,  ককবরক, অসমীয়া, ডিমাশা, মনিপুরী থেকে হিন্দি, গুজরাতি, তামিল তেলেগু----সব ভাষার কথা ।  নিজের ভাষা বাংলার কথাও বলতে চাই। ভাষাই হলো যে কোনো জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্ম পরিচয়ের প্রধান উপাদান। চিহ্ণ। যে জাতি নিজের ভাষা, মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলে, সে জাতি দুর্ভাগা। সে জাতি হয় আত্মপরিচয়হীন, অন্যের পরিচয়ে সে বাঁচে। সে বাঁচা অন্যের গলগ্রহ হয়ে বাঁচার মতো বলা যায়। যে জাতি নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলে, বা যে জাতির মুখের ভাষা, মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া হয় সে জাতি পদানত হয়েই থাকে।

     এখন যা বাংলাদেশ ১৯৭১-এর ২৬শে মার্চ আগে যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান, সেখানকার মানুষ নিজের ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে, অবিরল অসম্মানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় একটা দেশেরই জন্ম হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে নেইই প্রায় এমন বিরল ঘটনা।  আমাদের এই ভারত দ্বিখন্ডিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জন্ম সেই দ্বিজাতিতত্বকেই নস্যাত করে দিয়েছে। মিথ্যা প্রমাণ করেছে। প্রমাণ করেছে, ধর্মের চেয়েও ভাষার জোর বেশি। এই সব কথা সকলেই জানেন, অন্তত যাঁরা ভাষা নিয়ে ভাবেন তাঁরা। পাকিস্তান জন্মাল ১৯৪৭-সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে। পূর্ব পাকিস্তানের পরের মাসেই, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। বাংলা না উর্দু। সেই সময়ে পাকিস্তানের ডাক টিকিটে, রেলের টিকিটে উর্দু এবং ইংরেজি লেখা থাকত।
  
সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনের ভাষাও ছিল উর্দু কিংবা ইংরেজি। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। উর্দু ছিল ৫ % মানুষের ভাষা, যাঁদের বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের শাসকরা বলতেন বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়। বাংলা ভাষার ভিতরে নাকি হিন্দুয়ানির গন্ধ লেগে আছে। এ থেকে অসন্তোষ শুরু হয়। একটা দেশ জন্মাল দুই প্রান্তের মানুষের ভিতর বিবাদ আরম্ভ হয়ে গেল। নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ প্রস্তাব নেয়।  শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার অনঢ় ছিল তার সিদ্ধান্তে।  ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের  কুমিল্লা থেকে  নির্বাচিত গণ পরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে গ্রহণ করার জন্য এক বিল আনেন পারলামেন্টে। জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন । পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না যেয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনী সহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই  তা বাতিল হয়। পূর্ব পাকিস্তান দমেনি। আন্দোলন প্রতিবাদ সংগঠিত হতে থাকে। দাবিপত্র পেশ করা হতে থাকে।   ২১শে মার্চ ১৯৪৮ -এ  ঢাকার  রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা"। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।  ২৪শে মারচ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ "ষ্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং" শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলেন "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে। পূর্ব বঙ্গ তখন ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-র দিকে যাত্রা করেছে। দিনলিপি এমন হতে পারে।
  
 ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫২ ঃ  The Basic Principles Committee of the Constituent Assembly of Pakistan পুনরায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে এ্যাসেম্বলীতে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করে ।  শান্ত পূর্ব বঙ্গ ক্রমশ অশান্ত হয়ে যেতে থাকে। ভাষা নিয়ে এই আন্দোলন থেকে আসে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। পাকিস্তানের পশ্চিমী শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গের ভাষার দাবী ক্রমশ বৃহৎ হয়ে যেতে থাকে। জিন্নার না, পূর্ব বঙ্গের হ্যাঁ, জিন্নার উর্দু, পূর্ব বঙ্গের বাংলা অগ্নিগর্ভ করে তোলে পূর্ব পাকিস্তানকে। 
       ২৭শে জানুয়ারিঃ ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । সাথে সাথে সমাবেশস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শ্লোগান ওঠে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" । এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব - পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
   ২৮শে জানুয়ারিঃঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে । এই সমাবেশ থেকে নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদকে পশ্চিম পাকস্তানের হাতের পুতুল হিসাবে অভিহিত করা হয় ।
 ৩০শে জানুয়ারিঃ খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য ভাষা আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দান করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় ।
একই দিন মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি আওয়ামী মুসলিম লীগের সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
    ৩১শে জানুয়ারি ঃ  ভাসানীর সভপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে ।
    ৪ফেব্রুয়ারিঃ ছাত্রদের  ডাকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বত:স্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয় । ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবীতে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে ।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারী ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
 ২০শে ফেব্রুয়ারিঃপাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে আবুল হাশিম এর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভংগ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সভার একটি বড় অংশ ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে মত দিলেও অনেকেই এতে সহিংসতার আশঙ্কায় বিপক্ষে মত দেন ।
 ২১শে ফেব্রুয়ারিঃ সকাল ৯টা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু ।
সকাল ১১ টা : কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু । সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় । আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন ।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা : উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন । এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যু বরণ করেন । পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃত্যু বরণ করেন । অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় ।
বেলা ৪টা : ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে ।] গুলিবর্ষনের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবী করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকেঅনুরোধ করেন । সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকন্ঠ হন কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন । এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন ।  রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহবান সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয় ।
     ২২শেঃ  হাজার হাজার ছাত্র জনতা সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে । উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রুয়ারীনিহতদের স্মরণে কার্জন হল এলাকায় একটি জানাজা নামাজ আদায় করে এবং একটি শোকমিছিল বের করে । শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন । উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকারপক্ষীয় পত্রিকা "দি মর্নিং নিউজ " এর অফিসে আগুণ ধরিয়ে দেয় । নুরুল আমিন পুলিশের পাশাপাশি আর্মি নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে । আর্মি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক) এ জমায়েত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব ব্ক্তব্য রাখেন ।
উপায়ন্তর না দেখে নুরুল আমিন তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় ।
    ২৩শেঃ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে স্বত:স্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালিত হয় । এর আগের দিন আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব আনার পরেও নুরুল আমিনের পেটোয়া বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর দমন পীড়ন অব্যহত রাখে । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বরকত শহীদ হওয়ার স্থানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে ।
 ২৪শেঃ ভোর ৬টার সময় "শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের" নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় এবং সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির ফলক উন্মোচন করা হয় । নুরুল আমিনের সরকার রাজপথে সর্বত্র সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মোতায়েন করে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিবেশ স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় । এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয় ।
   ২৫শেঃ ছাত্র বিক্ষোভকে দমাতে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ।

  এরপরও  ভাষা নিয়ে পশ্চিমীদের বিরোধিতা চলতে থাকে। ১৯৫৬ তে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে স্বীকার করা হয়েছিল বটে, কিন্তু পশ্চিমীদের ঘৃণার অবসান ঘটে না।ক্ষমতার ভাষা উর্দু দিয়েই তাঁরা শাসন করতে চাইতেন।  আয়ুব খাঁ যখন সামরিক শাসক, রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল পূর্ব বঙ্গে। ভাষা এবং সাংস্কৃতিক দখলদারিই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙে দেয়। নতুন দেশের জন্ম হয়।
  ভাষা হলো যে কোনো জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্মসম্মানের বড় জায়গা। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে ১১জন মানুষ ভাষার দাবিতে আত্ম বিসর্জন করেন। অধিকার সেই বাংলা ভাষা। শিলচরের ঘটনাও ২১শের মতো চরম বেদনাদায়ক। নিন্দার্হ। আসামে এই সমস্যা মেটেনি। বরং বেড়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর ত্রাসে বাঙালি নিজের ভাষা ত্যাগ করে অসমীয়া হয়ে যেতে চাইছে। এই ভয়ানক  ত্রাস রোধ না করলে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হবে। অথচ  এই ভারতে  সব ভাষা, এখন ২৩টিই হলো রাষ্ট্রভাষা। হিন্দি এবং ইংরেজি  হলো রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা। এই ভারতে নোটের উপর সব ভাষা উদ্ধৃত থাকে। সাহিত্য অকাদেমি, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট সব ভাষাকেই সমান মর্যাদা দেয়। এই ভারতে সব ভাষাই বিকশিত হয়ে ওঠার কথা। তা যদি না হয়, দেশ আর দেশ থাকবে না। মনে রাখতে হবে,  ককবরক এবং হিন্দি উর্দু তামিল বাংলার একই অধিকার।

    ১৯৯৮ সালে্র জানুয়ারি মাসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার নিবাসী দুই বাংলাদেশের নাগরিক ( পরবাসী ) রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম জাতিসঙ্ঘের মহা সচিব কফি আনানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তাতে উল্লেখ করেন সমগ্র বিশ্বে  অনেক ভাষা চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাছে। গরিষ্টের ভাষা লঘিষ্ঠের ভাষাকে গ্রাস করছে। মাতৃভাষা মানব জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। মানুষের আত্মপরিচয় মাতৃভাষা দিয়েই নির্ধারিত হয়। এই কারণে সমগ্র বিশ্বে একটি দিনকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা স্মরণ করে ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস হিশেবে পালন করা হোক। এরপর এঁরা ভিন্ন ভাষাভাষী দশজনকে নিয়ে গঠন করেন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। এদের আবেদনে  নানা পদ্ধতির ভিতর দিয়ে গিয়ে ১৯৯৯ ১৭-ই নভেম্বর ১৮৮টি দেশের সমর্থনে ইউয়েনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিশেবে ঘোষণা করে। প্রস্তাব সমর্থকের  ভিতরে পাকিস্তান এবং চিনও ছিল। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে সমস্ত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। হ্যাঁ, পাকিস্তানেও। উর্দু ভাষাভাষী মানুষও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করবেন। একথা সত্য যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ভাষা। গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমান বিশ্বে ছ’হাজারের মতো ভাষা বিলুপ্তির মুখে। প্রতি দুসপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। কত জনজাতির কত ভাষা। মুখের ভাষা আছে, লিপি নেই। সংখ্যা গরিষ্টের ভাষা গ্রাস করছে সংখ্যা লঘিষ্টের ভাষা। এই প্রবণতা থেকেই কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হয়। এই দেশ বহুভাষিক। পরিচিত ভাষা ব্যতীত অচেনা ভাষা আছে কত জনজাতির। তা রক্ষা করাই ২১শে ফেব্রুয়ারির দায়িত্ব। বাংলাদেশের আদিবাসিজন, সাঁওতাল, মুন্ডা, চাকমা, পার্বত্য জাতিদের ভাষার কথা সেদেশের মানুষ ভাববেন। তবেই ২১শের দীপ সকলের হৃদয়ে জ্বলবে। এই দেশে রাজ্যগুলি ভাগ হয়েছে ভাষা ভিত্তিক।   সব ভাষা যদি সমান মর্যাদা না পায়, তবে ক্ষোভ জন্মাবে। আবার রাজ্যের ভিতরেই কত ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর ভাষা আছে। কুরমালি, সাঁওতালি,মুন্ডারি, রাজবংশী, হাজং ভাষা, গারো ভাষা, হো, কোল, ভীল, রাভা জনগোষ্ঠীর ভাষা, কোথাও লিপি আছে, কোথাও লিপি নেই, হারিয়ে গেছে। সেই সব ভাষাকে বিকশিত হতে  না দিলে ২১শের দীপ জ্বলবে না। ক্ষমতাবানের  ভাষার ( যেমন ধরা যাক হিন্দি, রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালিয়ে দেওয়া হয় ) দখলদারি থেকে মাতৃভাষাকে মুক্ত করতে হবে।  আর দেশ যে উদ্বেগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভাষাই হবে, মানুষের পরিচয়, ধর্ম নয়।  তবেই আমরা বাঁচব।


   

নীলমণি ফুকনের সঙ্গে কিছুক্ষণ: শমীক ঘোষ



' আমার কবিতা আর কিছু নয়। ঝিঁ ঝি পোকার ডাক'

অসমীয়া সাহিত্যের শিরোমণি শ্রী নীলমণি ফুকনের সঙ্গে কিছুক্ষণ 




তুমি তো বেশ সুদর্শন।’
জানতাম, চোখে ভালো দেখেন না। তাই অবাক হইনি একদম। বরং মুচকি হেসে, চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিয়েছিলাম । ‘সুদর্শন তো আপনি।’
প্রথমে মোটেও এত সহজ ছিল না কথা বলা।
নীলমণি ফুকন। অসমীয়া সাহিত্যের এক স্তম্ভ। প্রদ্মশ্রী। সাহিত্যে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান - সাহিত্য অকাদেমির ফেলো। সেও প্রায় ১৬ বছর হয়ে গেল। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, আমার জন্মেরও দু’বছর আগে।
অসমের যে কোনও বড় সাহিত্য পত্রিকা খুললেই অন্তত একটা কবিতা চোখে পড়ে যা ওঁকে উৎসর্গ করা।
বয়স ৮৫। অসম্ভব গুটিয়ে রাখেন নিজেকে। অসমের সাহিত্য জগতের কাউকে ওঁর সঙ্গে দেখা করার কথা বললেই, শুনতে হয় খুব অসুস্থ। সময় দেবেন কিনা জানি না।
ওঁর সঙ্গেই দেখা করব। সেই কথা বলেছিলাম অঙ্কুরদাকে। অঙ্কুর ডেকা। অসমের প্রথম সারির সাহিত্য পত্রিকা 'গড়ীয়সী'র সহকারী সম্পাদক। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন লেখক অরিন্দম বসু। অঙ্কুরদার গলার স্বর শুনেই বুঝেছিলাম, কাজটা কঠিন।
প্রথমেই আমাকে দেখে, অঙ্কুরদার দিয়ে তাকিয়ে অহমীয়াতে বললেন, বাংলাতো ভালো জানিনা। কথা বলব কী ভাবে? 
আমি ইংরাজিতে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘ইউ ক্যান  স্পিক ইন এনি ল্যাঙ্গুয়েজ ইউ ফিল কমফর্টেবল।’ 
কামাখ্যা পাহাড়ের উলটো দিকে, পাহাড়েরই কোল ঘেষে ওঁর বাড়ি। গাছ, গাছ আর গাছ। তার মধ্যেই সবুজ-সাদা একটা বাংলো।
অঙ্কুরদা আগের দিনই জানিয়েছিলেন, সকাল দশটায় সময় দিয়েছেন। চিরকাল দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা আমি, পৌঁছে গিয়েছিলাম ঠিক এক ঘণ্টা আগে। 
গাছে ঢাকা একটা লন। সেখান থেকে সামান্য উঠলেই পাহাড়ের অন্য ধাপে আরেকটা লন। সেইখানে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে রোদ পোহাচ্ছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। সামনে চায়ের কাপ। 
আমি যেতেই বৃদ্ধা উঠে এগিয়ে এলেন। আমি প্রণাম করলাম। একটা পা স্পর্শ করা মাত্র সাদা শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে ফেললেন আরেকটা পা। কিছুতেই আর খুঁজে পাইনা। ‘আরে পা’টা না খুঁজে পেলে প্রণাম করব কী করে?’ বহু কষ্টে আরেকটা পা খুঁজে পাওয়া গেল। তারপর নীলমণি ফুকনের সামনে। 
সারাজীবন ধরে তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে প্রকৃতি। অথচ সেই তিনিই অশান্ত অসমে পালটে ফেলেছিলেন নিজের স্বর। প্রকৃতির কথা না লিখে লিখেছিলেন, দীর্ঘ দিন ধরে তিনি শুধুই বাতাসে পোড়া টায়ারের গন্ধ পান। 
‘ইউ কমপেয়ার্ড ইয়োর পোয়েট্রি টু দ্য সাউন্ড অফ ক্রিকেটস।’ বলেছিলেন, ওঁর কবিতা আসলে আর কিছু নয়। ঝিঁ ঝি  পোকার ডাক। 
স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে কথা শুরু করলেন এইবার। ‘দেখো আমার মনে হয় পৃথিবীতে দুটোই জিনিস আছে। একটা কবিতা। আরেকটা মিউজিক। এত বয়স হয়ে গেল আমার। অক্ষর দেখতে পাই না আজকাল। এই বয়সে এসে মনে হয়, এত দিনে অন্তত দুটো তিনটে কবিতা লেখা উচিত ছিল। সেটাও হয়নি। পারিনি কিছুই।’ 
লনের ভেতরেই আরেকটা চেয়ারে বসে আছি। ওঁর দিকে প্রায় ঝুঁকে পড়েই। কথাটা শুনে মনে হল, এর সামনে চেয়ারে বসার যোগ্যতা আমার হয়নি। নীচের ঘাসের দিকে তাকালাম। একটা নাম বেরিয়ে আসছিল। ‘রিলকে।’ গিলে ফেললাম।
‘প্রকৃতি? আপনার লেখায় অসম্ভব প্রকৃতি আসে।’
‘অনেকে ভাবে আমি প্রকৃতি নিয়েই লিখি। তা তো নয়, প্রকৃতি আসলে মেটাফর। আসলে আমি তো প্রকৃতির মধ্যেই বড় হয়েছি। প্রকৃতির মধ্যেই থাকি।’ আশপাশের গাছগুলোর দিকে দেখান। থমকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
‘ফ্রেঞ্চ সিম্বলিজম?’
থমকে যান বৃদ্ধ। তাকান অঙ্কুরদার দিকে। আমি একটু ভয় পেয়ে যাই।
‘ফ্রেঞ্চ সিম্বলিজম – ক্রিটিকরা বলে। ফ্রেঞ্চ সিম্বলিজম নেই আমার লেখায়।’
‘আমি তখন কটন কলেজের ছাত্র। দেশ পত্রিকা পেলাম হাতে। ফরাসী কবিতা নিয়ে লেখা। সেখানেই আমি ফ্রেঞ্চ সিম্বলিজম বিষয়ে সামান্য জানতে পারি। ব্যাস। তারপর মালার্মের ওপর বই পড়লাম। বেশি না। আমার যে টুকু জানার জানা হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ফিরে তাকাইনি। তারপর ক্রিটিকরা বলেছে।’
‘অরুণ মিত্র।’ এবার কথাটা আর গিলতে পারি না আমি। 
‘কী লোক! কী লোক! কী সব কাজ করেছে। অসামান্য লোক। সব কিছু পাওয়ার পরে, সবার শেষে লোকটা কিনা সাহিত্য অকাদেমি পেল!’
আলোচনা বাঁক নেয় হঠাতই। ততক্ষণে প্রায় আমাকে চমকে দিয়ে প্রতি কথার ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি।
রবীন্দ্রনাথ থেকে কখন যেন পৌঁছে গিয়েছেন জীবনানন্দে। 
‘জীবনানন্দের বরিশাল আর আমার ছোটবেলা যেন একই রকম। আসলে বরিশাল উনি যেমন দেখেছিলেন, আমিও প্রায় সেই একই প্রকৃতিতে বড় হয়েছি। প্রথমবার পড়েছিলাম, পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে। পাখির নীড়। শব্দগুলোতে আটকে গিয়েছিলাম। ধানসিড়ি নদী দেখেছি আমি। অহমে আমরা বলি ধনসিড়ি। তোমরা বাংলায় বলো ধানসিড়ি। ওই নদীর ধারেই তো আমার শৈশব। শুনেছি জীবনানন্দ নাকি এসেছিলেন ওই নদী দেখতে। উনি যেদিন মারা গেলেন, আমি কলেজে পড়ি। খবরটা পেয়ে সারাদিন কেঁদেছিলাম।’
বাংলো বাড়ির বৈঠকখানায় সদ্যযুবা কয়েকজন অহমীয়া তরুণ এসেছেন।
‘স্যার...’
অসমীয়াতে সপাট উত্তর, ‘এখন ওঁর সঙ্গে কথা বলছি। ভেতরে গিয়ে বোসো।’
কখন যেন পোঁছে গেলেন ওঁর বাঙালি বন্ধুদের গল্পে। শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
‘শক্তিকে আমি খুব কম পেয়েছি। খুব কম। কী পাওয়ারফুল কবি। শঙ্খ ঘোষ, বড্ড বড় কবি। খুব বড়। আর ভালো মানুষ। ভালো মানুষ হওয়াও খুব কঠিন। খুবই কঠিন।’
দীর্ঘ সময় জুড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শঙ্খ ঘোষের কথা বলে গেলেন। শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে জরুরী বই খুঁজতে। সেই সময় সেখানকার লাইব্রেরিয়ান ছিলেন বিমল মিত্র। লেখক বিমল মিত্র নন। তাঁর সাহায্যের কথাও বলে গেলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। হঠাৎ সেখান থেকে চলে গেলেন আলালের ঘরে দুলাল প্রসঙ্গে। সেখান থেকে লাফিয়ে শিবনারায়ণ রায়। আমাকে বেশ কয়েকটা বই পড়ার কথা বললেন। সবই বাংলা বই। আমি পড়িনি। পাবলিশার্সের নামও বলে দিলেন। 
‘ফিজিক্সটা ব্যবহার করো লেখায়।’
বাইরের ঘর থেকে উৎসুক যুবকেরা আমার দিকে কেমন যেন ঈর্ষা নিয়ে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। আমি তাদের ঠকাচ্ছি এমন লজ্জা লজ্জা ভাব করছি মাঝে মাঝে।
‘তুমি এসে খুব ভালো করেছ। আজকে আমার দিনটা খুব ভাল যাবে। খুব ভালো। কত কথা যে মনে পড়ছে।’
চা টা সাহস করে খেয়ে ফেলেছি ততক্ষণে। প্লেটে রাখা খাবরগুলো স্পর্শও করিনি। ‘খেলে না কেন?’
‘কত বয়স থেকে লেখা শুরু করেছ?’
১৩-১৪ বছর বয়সে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম প্রথম। সে কথা চেপে গেলাম বেমালুম। প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল, ১৯-২০ বছর বয়সে।
‘ঠিক বয়স। খুব ভালো বয়সে শুরু করেছ।‘

ছবি তুলব। পাশে গিয়ে নীচ হয়ে দাঁড়িয়েছি। 
‘নীচু কেন?’
অঙ্কুরদা উত্তর দিলেন, ‘নীচু না হলে ছবির ফ্রেমে আটকাবে না।’
‘আমি দাঁড়াচ্ছি তাহলে।‘ অসময়ীয়া বহুক্ষণ পর।
‘না, না।’ আটকানো হল তাকে। 
ফিরে আসছি। দরজায় দাঁড়িয়ে ঋজুদেহের সুঠাম মানুষটা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘তুমি একদিন বড় লেখক হবে।’
‘স্যার দিস ওয়াজ ওয়ান অব দ্য মোস্ট মেমোরেবল এক্সপেরিয়েন্সেস অব মাই লাইফ।’
#
কলকাতায় ফিরে অঙ্কুরদাকে ফোন করলাম। ‘এসে গেছি।’
‘আমি নীলমণি স্যারের বাড়িতে, দাঁড়াও।’
ফোনে আবার সেই চেনা গলাটা!’ হ্যাপি নিউ ইয়ার!’ 
‘শোনও, আমি যে কী সব বললাম সেদিন! কোনও মাথামুণ্ডু নেই। লজ্জাই লাগছে। আমার স্ত্রীকে বললাম, আর বাইরে থেকে কেউ এলে আমি দেখা করব না।’
‘এমা আমি যে ভাবলাম আবার গুয়াহাটি গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করব।’
কাটাকাটা স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ, ‘তোমার জন্য আমার বাড়ির দরজা সব সময় খোলা।’


হঠাৎ একটা বাজি ফেটে উঠল কোথাও। কালো আকাশটা আলো আলো। কলকাতার রাতের আকাশে যেন হঠাৎ একটুকরো ব্রহ্মপুত্রের রোদ!

যশোধরা রায়চৌধুরী




এ পরবাসে রবে কে!

বাঙালি হিসেবে চাপে পড়ে যাই কখন জানেন? যখন ৪২ দিন অ-বাঙালিদের সংগে থাকতে থাকতে টের পাই, মনের যে কোন ভাব প্রকাশে বাংলায় যা কিছু ভাবি, তা কতটা অননুবাদনীয়! মনের ভেতরের কলকব্জা কতটা যে বাঙালিগন্ধী, তাকে অন্য ভাষায় নিয়ে আসা এক অসম্ভব ব্যাপার।
বিষয়টা গৌরবেরই। ভাবনা-ভাষার দৈন্য নেই, ছিল না, যদি দৈন্য কেউ এনে থাকি তা আমরাই নিজ পায়ে কুড়ুল মেরে। কেননা দৈনন্দিন ব্যাপারে আমাদের যা কিছু ভাবনা কথা তার অর্ধেকটা যে কবিতা বা গান থেকে উদ্ধৃতি, বা প্রবাদ প্রবচন বাগধারা, একঅসীম ঐশ্বর্য ময় বাংলা সংস্কৃতি। আর তার মধ্যে আবার আশি শতাংশ ই রবি ঠাকুর নির্ভর।
উদাহরণ দিলে ব্যাপার টা স্পষ্ট হবে। ধরা যাক রবিবার সকালে সবারই মুখভার, বেরনো যাবে না কারণ টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে, বাঙালির মন বলল, আজ কিছু তেই যায় না মনের ভার, দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার। 
অনুবাদ অসম্ভব। চলো ইয়ার কুছ খাতে হ্যায়। বলে ম্যানেজ করলাম, বিহারি ডিম ফেটাতে বসল আর দক্ষিণী ভাত পোড়ি পুলিয়াজারে পাউডার মিশিয়ে শুদ্ধ ঘি খুঁজল। আমার মন বলল, বাসনার সেরা বাস রসনায়। খাওয়া চলতে চলতেই ভাবা গেল যে এখন ভারতে সরস্বতী পুজো, মন বলল, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। খাবারে ছিল না চাটনির স্পর্শ, তাই বেজায় দুঃখ পেয়ে ভাবলাম, খিচুড়ি কুলের চাটনি এবার মিস। আমার একূল ও কূল দু কূল গেল। তাপ্পর খেয়ে উঠে আঁচাতে আঁচাতেই বললাম, ভাতঘুম চাই জমিয়ে। কে বোঝাবে ভাতঘুম ইহাদের?
একটু পরেই ঝকঝকে রোদ্দুর উঠল। অমনি বলে ফেলতে গেলাম, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি। কী জ্বালা। বললাম ছাতা লেকে নিকলতে হ্যায় মওসম আচ্ছা হো গিয়া!
অডিটি কাগজ দিচ্ছে না, মাথা গরম। ভাবলাম, হুঁ হুঁ বাবা ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি। অনুবাদ হবে না।
আমার টিমের লোকেদের ওপর খুব রাগ হচ্ছে, ভাবলাম, ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,/মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।.. অথবা কাউকে বেশি লাই দিতে নেই সবাই চড়ে মাথায়।
উফ আবার ক্যোটেশন! সুকুমার রায়।
...
বলছি না যে অন্য ভাষায় এসব থাকেনা। সবার মাতৃভাষায় এমন সব জানালা দরজা আছে যা দিয়ে পালানো যায়। যা আমাদের মায়ের কোল ফিরে দেয়। দুই তামিলিয়ান দেখা হলেই তাই হড়বড় করে মাদ্রাজীমার্কা কথা বলে নেয়। অথবা উর্দুভাষী রা তাদের নিজ মুদ্রায় নিজস্ব ভাষায় খানিক রসিকতা করে নেয়।
মাতৃভাষা আমাদের গোপন খুপরি খোঁড়ল ভাঁড়ার সঞ্চয় লুকোবার জায়গা।
দাঁড়াবার জায়গা।



সুমিতা সান্যাল





ভাষা দিবস

ভাষা দিবসে আমি কোন ভাষা খুঁজে  পাই না।
এ সমস্যা বরাবরের,
ক্রমশঃ বাড়ছে বাড়ছে,
শেষপর্যন্ত  এক পাহাড় উঁচু বাধা--
যার সামনে আমি দাঁড়িয়ে ।
আমার একটা ভাষা আছে
যেমন সবার থাকে,
অথচ কথা বিনিময়  হয় না।
এ এক স্নেহহীন সময়ের ভাষা,
যে শহীদরা মারা গেলেন
এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।
ওরাও কিছু বোঝাতে পারে নি-
শিকার  হয়েছে ভাষা না বোঝার
মৃত্যুটা কাজের জীবনের
উল্টোপিঠ।
জানি না জানি না।
নিজের কাছে একটা কিছু
বলে রাখা ।
যদি সবাই সবার ভাষা বোঝে,
তবে কেন কেউ কারো ভাষা
 বোঝে না?
ছোট্ট আশিফা নির্মমতার  শিকার
ওর কচি গলা থেকে বেরোনো চিৎকার-
কেউ শুনতে পায়  নি।
আমি সেই শিশুটির মৃত্যুযন্ত্রণা  শুনি,
ওর ভাষা কেউ বোঝে নি
আমি ওর ভাষা বুঝি।
আর আমি ভাষা বুঝি না।
আমার কোন ভাষা দিবস নেই।


আল মাহমুদের স্মরণে হিন্দোল ভট্টাচার্য




      বাংলা কবিতার ব্যক্তিত্বের নাম আল মাহমুদ



সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যাবসা শিখিনি
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন
আমারতো নেই শখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবেনা,
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরষ্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা- উপশিরা।
এ -তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেল সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়।
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবেকি হে বন্য বালিকা
অভাবের অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মত এঁকে দেব হিঙুলের টিকা।

সোনালী কাবিনের এ হেন প্রথম কবিতা বাংলা কবিতার জগতে যেন এক স্পর্ধিত ঘুরে দাঁড়ানোর ছবি এঁকে দিল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরে-তে তিনি দেখেছিলেন শিশু ও পশুর বিরোধ। এই বিরোধ তাঁর আজীবনের কাব্যকৃতির এক সম্পদ বলা যেতে পারে। এই বিরোধ নাগরিক আল মাহমুদের সঙ্গে তিতাস-পারের আল মাহমুদের, কবিতার স্বধর্মে বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে ধার্মিক আল মাহমুদের এবং সর্বোপরি ছিন্নমূল আধুনিকতায় বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে শিকড়-সন্ধানী আল মাহমুদের। বিনয় যাকে বলেন ‘ বিকাশের রাজনীতি এই’, তাকেই তিনি অন্য ভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন। আজীবন এক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে তাঁর কাব্যজীবন। সোনালী কাবিনের মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। অথচ সোনালী কাবিনের মধ্যে মহাকাব্যিক অভিযাত্রাও স্পষ্ট। যে যে বিষয়গুলিকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ মহাকবিতার কথা বলেছেন তাঁর কবিতার কথায়, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন সেই বিষয়গুলিকে ধারণ করে থাকে। এই যে ইতিহাসের এক ভিন্ন আবিষ্কারের মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছেন, ছোট ছোট অসংখ্য প্রতীকী বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেই সেইগুলিকে জন্ম দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। আল মাহমুদের কবিতার অন্যতম বিস্ময়ের দিক এখানেই বলে আমার অন্তত মনে হয়। একদিকে যেমন তিনি খনন করছেন, অন্যদিকে তেমন তিনি খনন করে যা যা পাচ্ছেন সেগুলিকে জন্মও দিচ্ছেন। তৈরি হচ্ছে এক অনবদ্য নতুন ভাষাপ্রবাহ। তিনি নিজে একটি গদ্যে লিখছেন- ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর, যেমন নদীর সাথে নারীর তুলনা… এখন আর প্রাণের সাথে প্রকৃতির তুলনা আমাকে তৃপ্তি দেয় না, বরং ছেলেখেলা মনে হয়… পবিত্র কোরান পাঠ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে আমার অতীতের সর্বপ্রকার ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকেই পালটে দেয়।’ কিন্তু এই আধ্যাত্মিকতা তো পরের দিকের। মনে হয় পরবর্তীকালের আল মাহমুদের আধ্যাত্মিকতা বরং অনেক বেশি অনুশাসিত, ইংরেজিতে যাকে বলে স্ট্রাকচারড। কিন্তু লোক লোকান্তরে, কালের কলস, সোনালী কাবিন, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাঘর যত পড়ি, তত মনে হয় প্রথম থেকেই তাঁর এক বিশ্বজনীন সংযোগ ছিল, যে সংযোগকেই মূলত বলা যেতে পারে আধ্যাত্মিকতা। এই সংযোগ একজন কবিকে চিরকালীন এক মহৎ কবিতার দিকে নিয়ে যায়। প্রত্যেক কবিই হয়ত আজীবন এই মহৎ কবিতা লেখার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়ের মতো সৃজনশীলতাও নয় একরৈখিক, যে একজন অভিজ্ঞতা লাভ করবেন, তবে তিনি সত্যের সঙ্গে সংযোগ করতে পারবেন। বরং এই সংযোগ অনেক ক্ষেত্রেই আসে অপ্রত্যাশিত ভাবে। এই যে মিথের দুনিয়া তিনি খুঁড়ে বের করেছেন বারবার তাঁর কবিতায়, এই যে টোটেম- লোকায়ত সংস্কৃতি- সৌন্দর্যবোধ আর ইতিহাসচেতনার জগতে তিনি অবগাহন করেছেন, তা তো একপ্রকার সেই অপ্রত্যাশিতকে পাওয়ার জন্যই। এই অপ্রত্যাশিত যেমন ঈশ্বর হতে পারেন, তেমন নাও হতে পারেন। ঈশ্বর হলেন কি হলেন না, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই সংযোগ হল কিনা! কারণ সংযোগ একপ্রকার ধর্মহীন, অনুশাসনহীন অপ্রত্যাশিত স্পর্শ, যা আল মাহমুদের কবিতায় দেবদূতের মতো আসে যায়।


আঞ্চলিক ইতিহাস, আঞ্চলিকতার রঙ, স্পর্শ গন্ধ জীবনানন্দের চেয়েও আরও নিখুঁতভাবে তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ‘লোকাল’ হলেও তাঁর কবিতায় কি এই ‘গ্লোবাল’ প্রেক্ষিত ছিল না? তিনি ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক শব্দ, আঞ্চলিক প্রতীকের সংসারকে। কথা বলেছেন সেই সংসারের, ইতিহাসের। কিন্তু তার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকতাকেও স্পর্শ করে আছেন। এই স্পর্শ করে থাকা কিন্তু নির্মিতি, সচেতন নির্মিতি। কিন্তু তার গঠন এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত, যে বোঝা যায় কবির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও। যেমন একটি সনেটে তিনি লিখছেন-

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম শান্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ,
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ

তাঁর জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এর অন্বেষণও তিনি করে গেছেন আজীবন। গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের স্রোত এসে যে একদিন শহর দখল করে নেবে, এ কথা তিনি ভেবেছেন। সে কথাও তো সোনালী কাবিনের কবিতাগুলিতেই স্পষ্ট। অনেক সময় তো কবিকে সব কথা উচ্চারণ করে প্রত্যক্ষ ভাবে বলতে হয় না। এভাবে বলার প্রয়োজনীয়তাও হয়তো অনেক সময় থাকে না। যেমন সোনালী কাবিনে ইঙ্গিতময় কাব্যের এক চূড়ান্ত অভিসার রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রত্যক্ষ ঘোষণার কবিতাও। সবথেকে বড় কথা সোনালী কাবিন একটি অনিবার্য কাব্যগ্রন্থ বলে মনে হয়। এমন একটি কাব্যগ্রন্থ্, যা হয়ত লেখার স্বপ্ন অনেক কবির থাকে আজীবনকাল।

বাংলা কবিতায় শুধু না, বিশ্ব কবিতার মানচিত্রে আল মাহমুদ এক চিরকালীন সাধনার নাম। নশ্বরতার ক্ষণস্থায়ীত্ব যাকে স্পর্শ করতে পারে না। 

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণে শমীক ঘোষ





… যে মিস্টিসিজম এর আগে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখায়!

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ তো দূর, তাঁকে সামনে থেকে দেখার সুযোগই কখনও হয়নি আমার। আমি যে সময় কলকাতায় ফিরে এসেছি, তখন তিনি খুবই অসুস্থ।
তবে আমি তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। সিনিয়র কথাসাহিত্যিকদের কাছে।
সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্ষরের সঙ্গে আমার আলাপ নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের মাধ্যমে। তাঁর লেখার মধ্যে ওই উপন্যাসটাই আমি প্রথম পড়েছিলাম। আমার তখন ১৩-১৪ বছর বয়স হবে খুব বেশি হলে। ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি। ওই ম্যাগনিচুডের উপন্যাস বোঝার বয়স ওটা নয়। আমিও বুঝিনি। কিন্তু ঘোর লেগে গিয়েছিল। মোহাবিষ্টের মতো আমি তখন শুধুই পড়ে গিয়েছিলাম। আমার শব্দভাণ্ডারে একটা আশ্চর্য শব্দ যোগ হয়ে গিয়েছিল। এমন একটা শব্দ যা কোনওদিন ব্যবহার করতে পারব না আমি। আবার ভুলতেও পারব না। সেই শব্দটার নাম ‘গাৎচোরেৎশালা’।


এই উপন্যাসটার শুরুতে আছে একটা নতুন জন্মের কথা। আঘুনের শেষ বেলাতে ধনকর্তার ছেলে সোনার জন্ম হয়েছিল। আর উপন্যাসের একদম শেষে আসে একটা মৃত্যুর কথা। সেই মৃত্যু তরমুজ খেতের মধ্যে ঈশম শেখের।
জন্ম থেকে মৃত্যু – তাঁর মাঝে নীলকণ্ঠ পাখির মতো এক অলীকের খোঁজ করে যায় মানুষ। পায় না। শুধু সেই আবর্তে যোগ হয় খিদে, ধর্ম, রক্ত, হিংসা ও রাজনীতির মতো নতুন মাত্রাগুলোর।
শুরু থেকেই এক অফুরান প্রকৃতির কথা। ধানক্ষেতের অন্ধকারের ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপ। সোনালি বালির নদীতে সূর্যের ডুবে যাওয়া। তরমুজের খেত। বিল। শালুক-শাপলা, জলপিপি পাখিদের কথা। বাংলার নরম মাটির কথা। আরও নরম, আরও আশ্চর্য গদ্যে।


চার্লস স্টুয়ার্ট, তাঁর ১৮১৩ সালে লেখা হিস্ট্রি অব বেঙ্গলের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “The province of Bengal was one of the most valuable acquisitions that was ever made by any nation… Its fertile soil produces everything requisite for the food of man and animal; and in such abundance that the crops of one year are sufficient for the consumption of its inhabitants for two.”
এত প্রাকৃতিক সম্পদ, এত প্রাচুর্য, তা তো সবার জন্য নয়! এই প্রকৃতির অনুষঙ্গেই আসে খিদের কথা। স্নিগ্ধ শাপলা – একটু নুন আর অল্প তেঁতুল গোলা দিয়ে অমৃত হয়ে ওঠে জালালীর কাছে। শাপলা তুলতে গিয়ে জলজ লতাপাতায় আটকে গিয়ে মারা যায় জালালী।
জালালীর মতোই জোটন। কিংবা মালতি।
আবার এই প্রকৃতির মধ্যেই উঠে আসে ধর্ম আর রক্তপাতের সম্পর্ক। ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরে পড়ে বলি দেওয়া মোষের মাথা থেকে। সেই মাথাটাই পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে ভীষণ অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে গিয়ে থামে বিলের মধ্যে কাজ করা গরিব মানুষের পায়ের কাছে।
মুড়াগাছার জমিদারবাড়িতে এই মোষের বলির রক্ত নিয়েই মানুষের উন্মত্ততার দৃশ্য দেখতে পায় সোনা।
অফুরন্ত প্রকৃতির বুকে খিদে, ধর্ম আর রক্তের অনুষঙ্গে ধীরে ধীরে চলে আসে ফেলু, আকলুদ্দিন জব্বররা। মালতি যেন হয়ে ওঠে এই জ্বলন্ত সময়ের সব থেকে বড় ভিকটিম। দাঙ্গায় স্বামীকে হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল সে। সেই গ্রামেই আবার লালসার শিকার হতে হয় তাঁকে। অসুরনাশিনী দুর্গার ভাসান হয়ে যাওয়া মূর্তির মতো মৃতপ্রায় সে ভেসে এসেছিল নদীতে। আবার খিদের তাড়নায় সেই মালতিই হয়ে উঠল চাল-পাচারকারী। ধরা পড়ে মাঠের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে শুয়ে পড়ে সে। বাবুটিকে প্রলুব্ধ করে। তারপর অতর্কিতে কামড়ে ধরে তাঁর কণ্ঠনালী।
এই ট্র্যাজেডিরই আরেক ভিকটিম ঈশম। আল্লার বান্দা সে। অথচ রাজনীতির এই জটিল আবর্তে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে।
প্রেম, যৌনতা, রাজনীতি, হিংসা, ধর্ম, খুন আর সব কিছু ছাপিয়ে মানুষের এক চিরায়ত অলীক নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ – সব কিছুই ধরা, সব কিছুই বলা। অথচ কী ভীষণ নরম করে। একটা অদ্ভুত মিস্টিসিজম দিয়ে। যে মিস্টিসিজম এর আগে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখায়!
বাংলা উপন্যাসে ইতিহাস-ধর্মী উপন্যাস লেখার এক বিরাট ধারা আছে। তাঁর সমকালীন লেখকরাও লিখেছেন। অথচ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বলেছিলেন, আমার যখন বর্তমান আছে অতীতে যাব কেন? কী আশ্চর্য, সেই বর্তমান দিয়েই বাঙালি জীবনের সাম্প্রতিক অতীতের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাকে ধরে রেখেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। নিরুচ্চার, আশ্চর্য অনাশক্তি দিয়ে। অদ্ভুত এক মিস্টিসিজম দিয়ে।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছিলেন, পথের পাঁচালির পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করেছে।
এই মিস্টিসিজমই যেন ধরা পড়ে সাদা আম্বুলেন্স-এ। পক্স হওয়ায় দীর্ঘ দিনের মনিবের বাড়ি থেকে রাস্তার নিম গাছ তলায় আশ্রয় নিতে হয় গরিব ভৃত্যকে। এমন প্লট অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে পরে বহু বাঙালি লেখকই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই নিমগাছের তলাতেই বারবার আসে একটা সাদা আম্বুলেন্স। রোগীকে তুলে নিয়ে যেতে চায় হাসপাতালে। অথচ সেখানে পক্সের জন্য কোনও আলাদা ওয়ার্ড নেই। তাই আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায় ওই গাছতলাতেই। এই সাদা আম্বুলেন্সও যেন ওই নীলকণ্ঠ পাখির মতোই এক মিস্টিক মেটাফর। এমন কিছু যাকে প্রবল ভাবে পেতে চায় মানুষ। কিন্তু তা অলীক। পাওয়া যায় না। এই গল্পের শেষে লেখক ক্রমশ যেন বাস্তবকে ছেড়ে এক অবাস্তবের দিকে চলে চান। দুই পথশিশুকে নিয়ে ওই মুমূর্ষু রোগি ফিরে যায় তাঁর ছেড়ে আসা মনিবের বাড়ির সামনে। এবং দেওয়ালের চারপাশে লিখে রাখতে লাগল অদ্ভুত একটা লেখা – ‘বড় মাঠে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যে যার চাষবাস করতে লেগে যাও। সবুজ চারায় ছেয়ে যাবে। ফুল ফুটবে ফল হবে। দিনমানে পৃথিবীর জায়গা বদল করে নাও।‘  
না পরাবাস্তব বা কুহক নয়, চূড়ান্ত আশাবাদও নয়। আমার মতে ওটা যেন আসলে একটা বিভ্রম। লেখকের নির্মাণ করা ইচ্ছেকৃত এক বিভ্রম। যেখানে তিনি বাস্তবকে আর মেনে নিতে চাননা, তাই ইচ্ছাকৃত এক বিভ্রম নির্মাণ করেন।
এমন আরও আশ্চর্য সব গল্পের কথা মনে পড়ছে যেমন – পোকা মাকড়েও খায়, বাঁচে, ভুখা মানুষের কোনও পাপ নেই, কাফের।


অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর বাংলা এবং সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে। তিনি মহীরূহের মতো লেখক। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল। এমনকি বাংলা লেখাগুলোতেও। তাঁর বিরাট সাহিত্যকীর্তির বিস্তারিত উল্লেখই নেই বেশিরভাগ লেখায়। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, মানুষের ঘরবাড়ি, ঈশ্বরের বাগান, অলৌকিক জলযানের মতো এমন মহাকাব্যের মতো সব উপন্যাস লেখার পরেও এমন হয়? হতে পারে?
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরাট মাপের ঔপনাসিক নিজের জানিয়েছেন যে প্রথম সারির দুটো পত্রিকার শারদ সংখ্যায় কখনও উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ পাননি তিনি। ছোট গল্পের জন্য আমন্ত্রণ পেতেন অবশ্য। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন ছোট গল্পের জন্যই। তিনি নিজেই বলেছিলেন, মেইন লাইনের লেখক হতে পারেননি। কর্ড লাইনের লেখকই থেকে গেলেন।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অতীন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, আজ হয়ত তিনি নিঃসঙ্গ যাত্রী, কিন্তু বিশ্বাস করি একদা আমাদের বংশধরগণ তাঁর নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা অনুভব করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তিরস্কার  বর্ষণ করবেন।
এর থেকে সত্যি কথা বোধহয় আর কোনও কিছু হতে পারে না।


সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ