Wednesday, February 20, 2019

তিনটি গল্প- শ্রীজাতা গুপ্ত





হাওয়া_মোরগ

রোজ সকালে এই সময়টায়  বারান্দার গাছগুলোয় জল দিতে আসেন অনসূয়া দেবী নয়নতারার মাথায় এখনও রোদ্দুর এসে পড়েনি দেখে সামান্য অবাক হলেন আজ চোখ তুলে মনে হল, হয়ত আবছা কুয়াশা জমেছে দূরে যেমন হওয়ার কথা এ সময়ে দয়াময় বাবু চা বানাচ্ছেন রান্নাঘরে পড়ার টেবিলে ফিরে অনসূয়া দেখবেন নীল সেরামিক কোস্টারের উপর সাদা কাপ থেকে সুগন্ধী ধোঁয়ায় অপেক্ষা করছে দার্জিলিঙ এ দৃশ্যের কোনও ঋতুকালীন তারতম্য হয়নি আজ অবধি
বারান্দায় বেরোনোর দরজার পাশে অনসূয়া দেবীর লেখাপড়ার টেবিল হাওয়া দিলে পর্দা নড়ে ওঠে, গায়ে এসে লাগে বেলা এগারোটা নাগাদ এক জোড়া পায়রা আসে রোজ, অনসূয়া দেবী কাজ থামিয়ে ওদেরই দেখেন গুবগুব করে ডাকে, ল্যাজ দুলিয়ে একে অপরকে ঘিরে ঘিরে ঘোরে আদরে ফুলে ওঠে বুকের পালক, বুজে আসে চোখ এইসব টুকটাক বিরতি কাজের মাঝে বড় ভালবাসেন অনসূয়া
ঘরের অন্যপ্রান্তে জানালার সামনে দয়াময়বাবুর কাজের ব্যবস্থা চেয়ারে বসলে কেবল আকাশটুকুই দেখা যায় দিনে সেখানে কতগুলি মেঘ এলো গেলো, সেদিকে চোখ থাকেনা দয়াময়বাবুর কাজের সময়ে মনোসংযোগে ব্যাঘাত কোনওভাবেই পছন্দ নয় দয়াময়বাবুর নির্লিপ্ত শান্ত আকাশ থেকে মুঠো মুঠো স্থৈর্য্য নিয়ে ডুবে থাকেন সারাদিন

অনসূয়া দেবীর পায়ের কাছে চুপ করে বসে থাকে একফালি রোদ যত বেশি মন দিয়ে রাখেন কাজে, রোদের আকার বেড়ে ওঠে তত পা বেয়ে কোলে উঠে বসে কিছুক্ষণ এরপর সারাগায়ে মাখামাখি করে চিবুক ছুঁয়ে যখন জোর করে আদায় করে নেয় অনসূয়ার নজর, ক্ষিদের তাপ বুঝতে পারেন অনসূয়া লাঞ্চ ব্রেক একটা নিতেই হয় আজ সারা মুখে পিঠে এসে ঢলে পড়েছে রোদ্দুর, তাও কেন উত্তাপে ঘোর কাটেনি তাঁর? হঠাৎই কি কমে গেল তেজ, যেমন হওয়ার কথা এ সময়ে দয়াময়বাবুর দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করেন,
-কী খাবেন আজ?
-ভাবিনি তো! আপনি কী খাবেন? আমি বানাবো?
-ভাবিনি কিছুই
এরপর কেটে যায় ঘন্টা তিনেক দয়াময়বাবু একবার উঠেছিলেন, অনসূয়ার পাশে কোন ফাঁকে রেখে গেছেন দু'টি কমলালেবু অনসূয়া দেবী রেখে এসেছেন চারটি কাজুবাদাম, দয়াময়ের টেবিলে বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে টের পেলেন, হঠাৎ শুষ্ক হয়ে উঠেছে আজ ত্বক কোল্ড ক্রিমের কৌটোটি বাথরুমে রেখে এসে চেয়ারে ফিরতে ফিরতে বলেন দয়াময়ের উদ্দেশ্যে,
-স্নানের পরে একটু ক্রিম মাখবেন এবার থেকে চামড়ায় টান ধরতে শুরু করেছে
-কেন? কেন টান ধরছে?
-ওই, যেমন হওয়ার কথা এ সময়ে
ভোরের প্রথম কুয়াশা, দুপুরের নিস্তেজ আয়েশি রোদ্দুর আর কমলালেবুর নিয়মে আজ সন্ধ্যা নামল কাজ শেষ হওয়ার বেশ আগেই বিকেলের চা বানিয়ে দয়াময়ের টেবিলে গিয়ে অনসুয়া জ্বালিয়ে দিলেন আলো চায়ের কাপ দেখে অনসূয়ার দিকে একবার বিস্ময়ে তাকালেন দয়াময় যে বইস্ময়ের কোনও ঋতুকালীন তারতম্য হয়নি আজ অবধি অস্ফুটে বললেন, “থ্যাঙ্কিয়ু..”
 নিভিয়া সুবাসিত মরশুমি হাসি ফিরিয়ে দিলেন অনসূয়াপড়াশোনায় ফেরার পথে জানতে চাইলেন,
-"আপনি কি বোঝেন, কতখানি ভালোবাসি আপনাকে?"

-"বুঝি..."

-"কী করে বুঝলেন?"

-"আবহাওয়া দেখে..."

(সংলাপ ঋণ: দয়াময় বাবু)
........

মাসকাবারি

-“এই লাউটা নেবেন দিদি? গায়ে যে অনেক দাগ ভরা দেব?”
-“এটাই নেবো আর ওই বেগুন দু'টো
-“ওতেও দাগ আছে একটু নখের দাগ বাজে কিছু না
-“অসুবিধা নেই ওইগুলোই দিন
একটা লাউ, দু'টো বেগুন, এক মুঠি কাঁচালঙ্কা আর দু'আঁটি ধনেপাতা আলপনার বাজারের থলিতে গুছিয়ে দিতে দিতে প্রভাস বলে,
-“আসলে সবাই নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখতে চায়, কচি কিনা যখন নিয়ে আসি নিখুঁত থাকে তেলতেলে চকচকে গা লাউটা আমার ঘরের পাশের মাচায় হয়েছে, দিদি আমি জানি কোনও সার পড়েনি স্বাদ খুব ভাল বাড়িতে বানিয়েছিল খোকার মা বেগুনগুলো ও পাড়ার রতনের থেকে কিনেছি ওরও বাড়িতেই হয় তাই আমি জানি, সঅঅব কচি স্বাদ খুব গুণও তবে ওই, কচি আছে কিনা দেখতে দেখতে সবাই খাবলে খুবলে রাখে দিনের শেষে মনে হয় বিশ্রী সারা গায়ে দাগ রূপ গুণ কিছুই নাই আপনি খেয়ে দেখবেন, আবার ফিরে আসতেই হবে আমার কাছে
আলপনা থলি ফেরত নিতে নিতে নীচু স্বরে বলে, “জানি তো আমি জানি
বছর পাঁচেক আগে অবধি, আলপনার বাবা যখন ছিলেন, আলপনাদের বাড়িতে নিয়মিত লোকজন আসতেন পাত্রপক্ষ চেনাশোনার মধ্যে খোঁজ পেলেই বাবা পোস্টকার্ড লিখতেন সম্ভাব্য পাত্রের পরিবারে যখন আর কেউ পোস্টকার্ড লিখতেন না, বাবা লিখতেন সাধুভাষায় ধরে ধরে লিখতেন, তাঁর একটি সুলক্ষণা বিবাহযোগ্যা কন্যা রয়েছে শিক্ষিতা, রুচিশীলা, ধীময়ী... ইত্যাদি ইত্যাদি বাবা যা লিখতেন না, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকত আলপনার গায়ের রঙ, উচ্চতা, উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়ি গাড়ি গয়নাগাটির সম্ভাবনা তা সত্ত্বেও, কোন অবিশ্বাস্য কারণে পাত্রপক্ষ আসবার আগ্রহ দেখাতেন পোস্টকার্ডে উত্তর এলে আলপনা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে আনত প্রসাধনী রূপাদির হাতের দু'গাছা চুড়ি, মান্তুদির ফেস পাউডার আশোক কাকুদের বাগানের রঙ্গন বা জবা খোঁপায় লাগাবে আলপনাএইভাবে পাড়ার সকলেই জেনে যেতেন আলপনা কে দেখতে আসছে আবার দেখতে আসার দিন দুপুরে আলমারি থেকে বের হত মায়ের হালকা নীল স্বর্ণকাতান অথবা বাসন্তী পিওর সিল্ক বাবা বাজার থেকে নিয়ে আসতেন মাটির খুঁড়িতে রসগোল্লা আর শালপাতায় মোড়া ফুলকপির সিঙ্গারা

দেখতে যাঁরা আসতেন, তাঁদের সঙ্গে আলপনার কথা হত খুব কম বাবার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হলে কিছুক্ষণ পর চা জলখাবার নিয়ে ঢুকত আলপনা ঘরে তখন কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, সন্ধে নেমে আসছে তখন বাবা উঠে আলো জ্বেলে দিতেন, যার ফলে নীরবতা ঘন হয়ে আসত আরও কিছুক্ষণ পাত্রপক্ষের বয়স্ক কেউ হয়ত জিজ্ঞাসা করতেন, “মা, তুমি গান জানো? রান্নাবান্না?” বেশিরভাগ সময় প্রশ্নের উত্তরে 'না' বলে ভিতরের ঘরে ফিরে যেত আলপনা বাবার অর্ধেক দীর্ঘশ্বাস কানে এসে বাজত ভিতরঘর থেকেই কখনও শুনতে পেত, “মেয়ের রঙ তো বেশ চাপা”, অথবা, “সোনাদানা কত দিতে পারবেন মেয়েকে, ভেবেছেন?” এ ভাবেই কচি মনে ধীরে ধীরে নখ পড়তে শুরু করল সত্যিই তো দেখার মত রূপ নেই, চলকে পড়ার মত অস্বাভাবিক গুণ নেই তার  টিপে টুপে বোঝার চেষ্টা করতেই হবে আর কি উপায় একে একে ফিরে যেত রূপাদির চুড়ি, মান্তুদির ফেস পাউডার বাগানের রঙ্গন বা জবা আরও দু'দিন রাখা থাকত বৈঠকখানার ফুলদানিতে পাড়াপরশিরা এরপরের কিছুদিন আলপনাকে দেখলে জিজ্ঞাসা করতেন, “কী রে খবর এলো কিছু?”
খবর আসেনি কোনওদিনই, এরপর উত্তর আসাও কমে এলো বাবাও লিখতেন কম আলপনার শরীরে এতদিনের খুঁটে দেখা দাগগুলি গাঢ় হয়ে উঠলে পরশিদের প্রশ্নও কমে এলোবাবা চলেও গেলেন তিন বছর আগে কাটাকুটি ভর্তি তরিতরকারির গা থেকে কাদা মাটি ঘষে তুলতে তুলতে আলপনা ভাবে, “ভেতরটা বোঝা যায়নি, ঠিকই এখনও তো তাজা
স্নান করতে করতে ক্ষতচিহ্নে হাত বুলিয়ে আলপনা রোজ ভাবে, “ভেতরটা বোঝা যায়না বাজারে এখনও তো...”
....

আশাবরী

সকাল থেকেই মন খারাপ করে বসে রয়েছে কাজল ঘুম ভেঙে প্রথমেই টের পেয়েছে, মনটা খারাপ নাকি মন খারাপ হয়েই ভেঙেছিল ঘুম? কফি নিয়ে জানলার ধারে এসে বসেছে, কাজে যেতেও মন চাইছে না সারাদিন ধরে বেশ আয়েশ করে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে মন খারাপটা হ্যাঁ, কিছু কিছু মন খারাপ এরকম হাতছানিতেই আসে ছায়াময় মুগ্ধতায় কাছে টানে ঘিরে থাকে অনাবিল শান্তি নরম স্নিগ্ধতা আজ সেরকমই জানলার বাইরে অনির্দিষ্ট তাকিয়ে থাকছে কাজল কফি কাপের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে ভোরের বাতাসে, সামনের গাছে এসে বসল বাদামি শালিখ, বাজার যাচ্ছেন প্রতিবেশী এইসব লঘু দৃষ্টিপাতের মাঝে মাঝে চোখ আটকে যাচ্ছে হঠাৎ কোথাও যেমন, জানলার গরাদে এক বিন্দু জলে কাল বৃষ্টি হল? আবার কিছুক্ষণ অবিন্যস্ত ঘুরে থমকে যাচ্ছে কাজল নিজেরই হাতের পাতায় রেখাগুলো কী মসৃণ কেমন মিলেমিশে সাবলীল চলন তাদের বেলা বাড়লে, কখনও ধৈবতে, কখনও বা গান্ধার ছুঁয়ে নেমে আসছে কার্নিশে জৌনপুরী রোদ 'জৌনপুরী রোদ' কথাটা বারবার বলতে ভালবাসেন কাজলের প্রিয় মানুষ তাঁর গলায় যেমন সরল স্নেহ, সেখান থেকেই ধারদেনা করে ধৈবত গান্ধার এসেছে আজ কাজলের ঘরে সবটাই কোমল সম্পূর্ণতা না পেয়েও ফিরে যাচ্ছে অপূর্ব সম্পূর্ণে
সারাদিনে, কাজের মাঝে, ফুটপাথে এসে পড়া বেলা অবেলার আলোয়, আজ কেবল জৌনপুরী রোদ দেখল কাজল জৌনপুরীর সময় তখন পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণপ্রায় বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এলো যা কোত্থাও নেই, তাও যেন চোখে পড়ছে, কানে আসছে আজ এই যেমন, প্রিয় কণ্ঠস্বরে 'জৌনপুরী রোদ'... 'জৌনপুরী রোদ'... এ তো আসলে আজ কোথাও বলছে না কেউ তাও কেন কাজলের মনে হচ্ছে ও দেখতে পাচ্ছে কথাটা? হ্যাঁ, দেখতেই পাচ্ছে কারুর কারুর কথা যেমন দেখা যায় স্পষ্ট  ধৈবতের কোমল নেশায় তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে ষষ্ঠ স্নায়ু মগ্ন হয়ে ওঠে আর্দ্র নয়ন একবার ফোন করবে? বলবে, 'আরেকবার বলুন না,  ওই কথাটা'... শুনি...' ইচ্ছে করল না এই যে, এমন না থেকেও কাজলকে ঘিরে ধরেছে দু'টি শব্দ, অস্পষ্ট সুর, অলৌকিক এক রোদ্দুর, আজ না হয় সে নিয়েই কাটবে
ঘরে ফিরে টুকটাক কাজ থাকেইসেসব শেষ করতে করতে কাজলের মনেই নেই সকাল শুরু হয়েছিল মনখারাপে মনে নেই বললে ভুল হবে বরং সেই মন খারাপের বিস্তারেই আজ একে একে সুর জমেছে দিনভর বিভিন্ন রাস্তায় ধরা দিয়েছে মন খারাপের রকমফের সন্ধে বাড়ছে এখন নাভীর অতল থেকে অদ্ভূত এক আলোড়ন টের পাচ্ছে কাজল আরও বেশি সুর এসে যেন জাপটে ধরছে তাকে কোমল স্বরগুলি ছাপিয়ে প্রবল হয়ে উঠছে শুদ্ধ কিছু স্বর ঝাপসা চোখ থেকে ভেসে উঠছে অভ্যন্তরীন দৃপ্ত একটি চোখসহজ স্নেহ থেকে বেরিয়ে এসে ধরা দিচ্ছে হিংস্র আদর কোথায় গিয়ে থামছে দর্শন? ঋজু ঋষভে, কখনও পঞ্চম আরও এত সুর কেন ঢুকে পড়ছে ঘরে? রাত বাড়ল,  তাই?
ফোনের দিকে হাত চলেই যাচ্ছে বারবার সেই যে সকালের সামান্য ইচ্ছেটিকে পাশ কাটিয়ে স্থির হয়েছিল শান্ত উপাসনায়, নীরব উপাসনায়, তা' তোলপাড় করে মেতে উঠছে মন জেগে উঠছে শরীর বারবার মনে হচ্ছে একবার কথা না বললেই নয় এক্ষুণি লিখে ফেলতে হবে কতখানি চাইছে সে ফোনের ওপার থেকে আঙুলের ছোঁয়া কতখানি...চাইছে কাজল... নিমিলিত রোদ ভেঙে জমাট রক্তের মত রাতে এসে দাঁড়িয়েছে বিস্তার এই বারবার মনে হওয়া, অমূলক চাওয়া, এ বুঝি কোনও উপাসনা নয়? সম্পূর্ণের দিকে এগিয়ে চলা রাত্রির একমাত্র গন্তব্য নয়? দরবারি কানহাড়া নয়? কাজলের আশাবরী মন ভেঙে একে একে সকাল আর রাত্রির গড়ে ওঠা নয়?


7 comments:

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ