Wednesday, February 20, 2019

সরোজ দরবার





শহিদ ও একটা বাবুইয়ের বাসা

আসলে কেউই যুদ্ধ চাইয়নি। চেয়েছে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকতে।
আসলে কেউই দেশলাই আনেনি সঙ্গে। চেয়েছে তবু মোমবাতি জ্বালাতে। শোকের। ভেবেছিল, কেউ না কেউ ঠিক নিয়ে আসবে  সঙ্গে। তার থেকে আগুন চেয়ে নেওয়া যাবেখন। কেউ একজন এনেওছিল। ফলে মোমবাতি জ্বলল, নির্বিঘ্নেই। কিন্তু এই যে প্রত্যেকেই আগুন সঙ্গে আনেনি, এই আক্ষেপে দুটো মোমবাতি জ্বললই না। আর গোটা তিনেক জ্বলেও দপ দপ করে নিভে গেল। বাকিরা নিরুপদ্রব পুড়ে যাওয়াই অবশ্য মেনে নিল। তাদের নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
কিন্তু যারা জ্বলেও নিভে গেল, তাদের থেকেই গল্পের শুরু। শুনেছি, আগুন নাকি পাচার হয়। তাহলে এই আগুনও নিশ্চয়ই কোথাও গেছে। এই গল্প সেই আগুনকেই খুঁজবে। যদিও তার আগে চিনে নিতে হবে রঞ্জনকে। যার জন্য এই শোক, যার জন্য এত্ত সবকিছু।
রঞ্জন মারা গেছে। অবশ্য মারা গেছে বললে কারও ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে। লাগতেই পারে। আবেগ তো ফ্যান কোম্পানির রেগুলেটর নয় যে, কাঁটায় কাঁটায় মেপে বাড়বে বা কমবে। তিন-এর ঘোরা আর পাঁচ-এর ঘোরা সমান। সকলের জন্য এক। আবেগ এত অঙ্কতুখড় নয়। সুতরাং যদি কারও আবেগ আহত হয়, তাকে সম্মান করাই ভাল। এবং তাই বলা ভাল রঞ্জন শহিদ হয়েছে। যুদ্ধ হয়নি কোথাও। রঞ্জন সন্ত্রাসীদের হামলায় শহিদ হয়েছে।
কিন্তু একটা যুদ্ধ হয়েছিল। এবং রঞ্জন বহুকাল হল সে যুদ্ধে মারাও গিয়েছিল। এটা হলফ করে বলা যায়। যেহেতু এটা রঞ্জনের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই এ নিয়ে কেউ আপত্তি করতে পারবেন না। কারণ এখানে কোনও দেশের ধারণা জড়িয়ে নেই। এ অনেকটা আত্মহত্যার মতো। ব্যক্তিগত।
যাকগে মূল কথায় ফিরি। পরমার যেদিন বিয়ে হয়েছিল, রঞ্জন সেদিন ভোর দেখেনি। অনেক রাত অবধি নেশা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন চোখ খুলল, তখন কনেবিদায় হয়ে গিয়েছে। পরমাদের বাড়ির সামনের গেট থেকে রঙিন কাপড় আর ফুলের সাজ খোলা হচ্ছে। ভাঙা হাট। রঞ্জন সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল অনেকক্ষণ। যে দু-একজন তাদের ভাব-ভালোবাসার কথা জানত, তারা রঞ্জনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অন্যত্র। বলল, বিড়ি খাবি? রঞ্জন ঘুমভাঙা উদাস গলায় বলেছিল, দাও। ওরা বিড়ি দিল। রঞ্জন পরপর দুটো বিড়ি ফুঁকে, কী মন গেল, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরল।
ওর একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ ছিল। ভারী প্রিয় জিনিস রঞ্জনের। সর্বদা আগলে রাখত। আর মাঝে মধ্যেই চেনটা ইষৎ টেনে ফাঁক করে, ব্যাগের ভিতর কী যেন দেখত। আসলে তাতে হাবিজাবি অনেককিছুর সঙ্গে ছিল একটা বাবুই পাখির বাসা। একদিন ডহরের ধারে পরমা ওটা রঞ্জনের হাতে দিয়েছিল। রঞ্জন ভ্যাবলার মতো বলেছিল, কী হবে? পরমা কনে দেখা আলোয় রাঙা হাসি হেসে বলেছিল, এরকম একটা সুন্দর ঘর তৈরি করব আমরা।
রঞ্জন কিছু বলেনি। মানে বলতে পারেনি। কীই-বা বলবে। এসব মুহূর্তে প্রেমিকমাত্রই মূক। কারণ কথা দিয়ে সে সবটা ছুঁতে পারে না। রঞ্জনও পারেনি।  শুধু ঘরে ফিরে ক্যাম্বিসের ব্যাগে যত্ন করে তুলে রেখেছিল প্রেমিকার স্বপ্নকে। সেদিন থেকে তার গোপন সম্পত্তি হয়ে উঠেছিল এই বাবুয়ের বাসাটি।
রঞ্জনের কাছে পরমার কোনও ছবি ছিল না। সে এই বাসাটিকেই তাই পরমার স্মৃতি হিসেবে নিয়ে, ক্যাম্বিসের ব্যাগটা পিঠে ফেলে সবার অলক্ষে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল।
এখন এই বাবুইয়ের বাসার গল্পটি কতটা সত্যি আমাদের জানা নেই। কারণ সেই একান্ত মহূর্তে আমরা কেউই ওদের কাছাকাছি ছিলাম না। তবে রঞ্জন নাকি বহুবার তার বন্ধুদের বলেছিল, বাবুইয়ের মতো ঘর গড়বে সে, পরমাকে সঙ্গে নিয়ে থাকবে।
সেসব কিছুই হয়নি। বাবুইয়ের বাসার গল্পটা তাই মিথ্যেও হতে পারেতবে রঞ্জন মারা গেছে বা শহিদ হয়েছে – যাই হোক না কেন- রঞ্জন নেই, এই ব্যাপারটা সত্যি। কারণ এখনও কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে, তারই স্মৃতিতে।



২)
যুদ্ধটা যারা চাইছে বা চাইছিল, তারা কেন চাইছিল? রঞ্জনকে ভালোবাসে বলে? ভালোবেসে বদলা চাইছে? নাকি রঞ্জন মরে যাবে বলেই চাইছে?
আচমকাই ভাবনাটা মাথায় আসে রঞ্জনের। আরও গভীর একটা প্রশ্নের ভিতর সে ঢুকে পড়ে। ভালোবাসা, খুব ঘন ভালোবাসা কি তবে কারও মৃত্যুও কামনা করে?
ভাবছিল রঞ্জন। কারণ এবারের মৃত্যু তাকে বড় একটা কাহিল করতে পারেনি। প্রথমবার যখন সে মারা গিয়েছিল, সেটাই তার কাছে এখনও পর্যন্ত সঠিক মৃত্যু। তার অভিঘাত সে এই দ্বিতীয় মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু যেহেতু মৃত্যু ব্যাপারটা শিরায় শিরায় চারিয়ে গিয়েছিল, তাই দ্বিতীয় মৃত্যু তাকে বিশেষ কাবু করতে পারেনি।
রঞ্জন জানত, জীবনের সঙ্গে কখনও মৃত্যুর দেখা হয় না। হয় জীবন, নয় মৃত্যু। এর মাঝামাঝি কিছু নেই। যেখানে জীবনের শেষ, সেখানে মৃত্যুর শুরু। তাই তাদের পরস্পরে দেখা হয় না। মৃত্যুকে দেখে না বলেই তো জীবনের ভয় ভয় করে, মৃত্যুভয় পেয়ে বসে জীবনে অচেনা অজানাকে যেমন ভয় পায় বাচ্চারা। রাক্ষস দেখেনি বলেই সে জিনিসটাকে ভয় পায়, জুজুর ভয় পায়। যখন এইসব দেখে ফ্যালে বা বুঝে ফ্যালে এরকম কিছু নেই, তখন আর ভয় থাকে না। কিন্তু জীবনের সে উপায় নেই। মৃত্যুকে সে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হিসেবে কখনওই পায় না।
কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে রঞ্জন একটা কথা বুঝতে পারল, একবার জীবনের ভিতর বসে, মৃত্যুকে দেখে নিলে, আর কোনও ভয় থাকে না। সেটা যে সম্ভব হয়, তাও সে জানত না। মানে এক জীবনে জন্মান্তর হয়, এটা সে শুনেছিল। কিন্তু এক জীবনে একটা মৃত্যু থেকে দ্বিতীয় মৃত্যুতে পৌঁছানো যায়, এটা সে জানত না। অথচ হল তারই সঙ্গে।
ক্যাম্বিসের ব্যাগটা পিঠে ফেলে যখন সে চলে যাচ্ছিল, তখন সে একটা যুদ্ধই লড়ছিল। তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল একটাই প্রশ্ন, সে চলে যাচ্ছে কেন? আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, সে পালিয়ে যাচ্ছে কেন? ভালোবাসা তো কম পড়েনি। ভালোবাসা জ্যোৎস্নার মতো। এই তো এখনও সে কি পরমাকে আর ভালোবাসে না? বাসে তো। তাহলে তার তরফে কোনও খাদ নেই। কিন্তু পরমাকে কি তাকে ভালোবাসবে আর? বাবুইয়ের বাসা দেওয়া সেই বিকেলটা আচমকা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল রঞ্জনের। আর সে তখনই স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছিল যে, পরমা তাকে ভালোই বাসবে। রঞ্জনকে ভালোবাসা ছাড়া পরমা তার ফেলে যাওয়া জীবনটার সঙ্গে কোনও যোগসূত্রই খুঁজে পাবে না। জীবনের এই বাইশ কি চব্বিশটা বছর যদি একেবারে ভুলে না যায়, তবে রঞ্জনকে পরমা ভালোই বাসবে। গোপনে। ভীষণ গোপনে। যেভাবে শৈশবের স্মৃতিরা থেকে যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিড়েও স্মৃতিতে থেকে আপাত অদরকারি কিছু কথা, ঘটনা। সেভাবেই থেকে যাবে রঞ্জন। পরমার কাছে, একান্তে।
এই কি যথেষ্ট নয়? নিজেকেই প্রশ্ন করে রঞ্জনতার বুকেও ভালোবাসার দিঘি। পরমার বুকেও ভালোবাসার সরস্বতী। দেখা না যাক, গোপনে বেঁচে থাকবে। এই ভালোবাসা কি পর্যাপ্ত শীতলতা দেবে না! নিশ্চিতই দেবে। এই ভালোবাসা তার সর্বাঙ্গের তাপ জুড়িয়ে দিতে পারে‘আমি পরমাকে ভালবেসে ভালো আছি’, এর মধ্যে তো আর কোনও গা-জোয়ারি নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, বাবুইয়ের বাসা নেই। এটুকুই তো সব। বস্তুত খাঁটি সোনা। তাহলে সে নিজের থেকে নিজে পালাচ্ছে কেন? শুধু বাবুইয়ের বাসাটা এ যাত্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল বলে!
কথাটা মনে হতেই সেটা ব্যাগ থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলতারপর আবার কী মনে হতে কুড়িয়ে নিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল একটা গাছের ডালে। হাজার হোক একটা স্বপ্ন তো, মাটিতে একেবারে ফেলে দিতে নেই।  
সেদিন রঞ্জন বেঁচেই গিয়েছিল। কিন্তু তারপর তার মরণ শুরু হল। যত দিন যায়, তত সে বুঝতে পারে, পরমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কিন্তু পরমা তো তাকে ছাড়াও তাকে ভালোবেসে বেঁচে আছে। তাহলে!
চোখ বুজিয়ে ভাবতে বসে রঞ্জন। আর যুদ্ধটা ফিরে আসে। এক রাতে সে কী তুমুল যুদ্ধ হল। ভিতরে ভিতরে বেদম রক্তপাত হল, টের পেল রঞ্জন। এবং অবশেষে সে বুঝল, পরমাকে নয়, সে আসলে খুঁজে ফিরছে সেই বাবুইয়ের বাসাটিকে। সেটা তো ঘর নয়। তাদের ঘরের প্রতীক। যে ঘর হওয়ার ছিল। যা হয়নি। কিন্তু সেই প্রতীকটিকে পাবার জন্য সে এমন তীব্র আকুল হল যে পরমার মুখখানা পর্যন্ত সে ক্রমশ ভুলে যেতে থাকল। এবং একদিন বুঝল সে মরে গেছে। যুদ্ধ তাকে মেরে ফেলেছে।
পরমাকে সে ভুলে গেছে। বাবুইয়ের বাসা সে আর খুঁজে পায়নি।
সেদিনই তার প্রথম মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছিল। সে খবর একমাত্র সেই-ই পেয়েছিল।
মৃত্যু পরবর্তী ভূতের জীবন নিয়ে সে আর বিশেষ ভাবেনি। তারপর সে ঠিক কী কী করেছে, তা মনেও রাখেনি। শুধু আজ এই কাঁপা-নেভা মোমবাতির শিখা মনে করাচ্ছে, তার দ্বিতীয় মৃত্যুও হয়েছে। সম্ভবত এরপর আর তার মৃত্যু হবে না।
শুধু একটা প্রশ্নেই তার যাবতীয় অস্তিত্ব আটকে আছে। সকলে যুদ্ধ চাইছে কেন? কেউ মরে যাবে বলে! যুদ্ধ হলে কেউ না কেউ তো মরবেই। যারা মরবে তাদের জন্য এভাবেই পালিত হবে শোক। অপার ভালোবাসায়। তাহলে ভালোবাসার গোড়ায় কি মৃত্যুকামনাও আছে? পরমাও কি তবে কোনোদিন চেয়েছিল, রঞ্জনের মৃত্যু হোক!
রঞ্জন একদৃষ্টে নিভে যাওয়া মোমবাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবে। ভেবে কূল পায় না বলে আবার তাকিয়েই থাকে।

৩)
অনেক অনেকদিন পর, পরমার মনটা হু-হু করে ওঠে রঞ্জনের জন্য। কিংবা তার নিজের জন্যেও। রঞ্জনের মৃত্যসংবাদ সেও শুনেছে। আর আচমকা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, সেই কনে দেখা বিকেল, সেই বাবুইয়ের বাসা।

রঞ্জনকে পরমা ভোলেনি। কিন্তু আলাদা করে মনেও রাখেনি। রঞ্জন তো ক্যালেন্ডারের লাল দাগ নয় যে, বিশেষ দিন ধরে মনে রাখোতে হবে।
রঞ্জন পরমার সংসারও নয় যে দুপুরের খাওয়া, রাতের দরজা বন্ধের খেয়াল রাখতে হবে।

রঞ্জন পরমার ভালোবাসা। কখনও বহুদিন বাদে মনে পড়েছে। কখনও দিনের পর দিন ভুলেই থেকেছে। কিন্তু বাবুইয়ের বাসার কথা কোনোদিনই মনে পড়েনি তার। আজ পড়ল। যখন রঞ্জন আর নেই। তখন মনে পড়ল, তাদের একখানা ঘর বাঁধার কথা হয়েছিল। সে ঘর হয়নি। ঠিকই। তবে ভালোবাসার ভিতর একখানা ঘর বাঁধা যায়। সে ঘর নিয়ে পরমা বেশ ছিল। সে ঘরে ইট-কাঠ লাগে না, এমনকি বাবুইয়ের বাসার মতো খড়কুটো নয়। সে বেশ একখানা হাওয়ার ঘর।

কিন্তু পরমার আজ যে কারণে মনটা হু-হু করল, তা অদ্ভুত। তার মনে পড়ল বাবুইয়ের বাসাটা তার কাছে ছিল না। ছিল রঞ্জনের কাছে। সে তাই ভুলে থেকেছে। বা ভুলে গেছে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু রঞ্জন কি পেরেছিল!
যদি রঞ্জন বাবুইয়ের বাসাখানা ফেলে দেয় তো ল্যাটা চুকে গেল। সেও তার মানে হাওয়ার ঘর বুকে নিয়েই পৃথিবী থেকে চলে গেছে। আর যদি কাছে রেখে দেয়! আজীবন যে ঘর নেই তার স্মারকটিকে যদি বুকে আগলে রাখে, না-হওয়া ঘর খুঁজে ফেরে! আহা রে! সে বড় কষ্ট! বড় যন্ত্রণা। গুলির থেকেও কি সে ক্ষতের জ্বালা বেশি! এ কথা মনে পড়তেই পরমা অস্থির হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে, অন্তত সম্ভাবনা আছে যে, রঞ্জন এক গভীর কষ্ট সয়ে সয়েই, ক্রমে ক্রমে মরতে মরতে একেবারে মারা গেছে। যে কষ্ট পরমা পায়নি। রঞ্জনের সেই দীর্ঘকালীন ব্যথার কথা মনে করে চোখে জল আসে পরমার। হাওয়ার ঘরের খোঁজটা রঞ্জনকে একবার অন্তত বলে দেওয়া উচিত ছিলকিন্তু জীবনে যে তাদের আর দেখা হয়নি। সেদিন বাবুইয়ের বাসাখানা দেওয়ার জন্য আজ তার নিজেকে গভীর অপরাধী মনে হয় রঞ্জনের কাছে। কিন্তু ক্ষমা চাইবে উপায় নেই। রঞ্জনই তো নেই।

অনেকেই তাকে রঞ্জনের শোকসভায় যেতে বলেছিল। এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও বলেছিল। বাপের বাড়ির পাড়ায় এতবড় ঘটনা। মিডিয়া ভেঙে পড়ছে। আর পরমা যাবে না! হাজার হলেও প্রতিবেশীই তো!
পরমা বলেছে, সবই তো টিভিতে দেখছি। আর গিয়ে কী হবে!

যা সে বলতে পারে না, তা হল এক যুদ্ধের কথা। হাওয়ার ঘর আর বাবুইয়ের বাসার যুদ্ধ। পরমা কি রঞ্জনের প্রতি আর একটু সদয় হতে পারত না! আজ এই বয়সকালে এসে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়, রঞ্জনকে সেই-ই অনেকদিন আগে মেরে ফেলেছিল। যেদিন সে তাকে বাবুইয়ের বাসা দিয়েছিল। এই মৃত্যু তাই-ই আলাদা কিছু নয়।
পরমা এবার গোপনে কেঁদে ওঠে। তবে আর পাঁচদিনের মতোই ঘরের কাজ সারে। বাসি কাপড় পালটায়।
পরমা আর পাঁচদিনের মতোই রঞ্জনকে ভুলে যায়। আবার মনেও করে।

রঞ্জনের জন্য পরমা শোক প্রকাশ করে না কোথাও। সামনাসামনি। রঞ্জনের জন্য দেখিয়ে তাকে কিছু করতে হবে, এমনটা ভাবতেও পারে না পরমা। কারণ পরমা জানে, রঞ্জন তার অন্তরের কুয়োর জল। শীতল। কেউ তা পান করে না। কেউ তার অপচয়ও ঘটায় না। শুধু সব পিপাসা সে মিটিয়ে দেয়। একান্তে, গোপনে। রঞ্জনের আততায়ীও সে, রঞ্জনকে বিশল্যকরণীও দিতে পারে সেই-ই। পরমার তাই কোনও হেলদোল কারোর চোখে পড়ে না। রঞ্জনকে সে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে যেন! হাওয়ার ঘরে।

শুধু কেউই খেয়াল করেনি, রঞ্জনের মৃত্যুসংবাদ আসার পর, পরপর তিনদিন পরমার তুলসীমঞ্চের পাশে জ্বলে উঠেছিল তিনটে মোমবাতি। শোকসভায় আক্ষেপে যারা নিভে গিয়েছিল। অথবা আগুনপাচার করে উঠে আসতে চেয়েছিল শুধু পরমার কাছেই                 
 

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ