যে ভাষার
জন্যে এমন হন্যে...
একটা সভ্যতা কোনদিকে নিয়ে যাবে তোমাকে!
একটা সমাজ! একটা গোষ্ঠী! শিখর অথবা
কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে... শেষ গন্তব্য হতে পারে একটা জাতির সীমানা... ভালোবাসা
কিংবা আবেগ পর্যন্ত! তাই না? কিংবা ধরা
যাক, একটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাইলে,
কীভাবে আঘাত হানা যেতে পারে তার কেন্দ্রে? কীভাবে আস্তে আস্তে তার মর্জায় মিশিয়ে
দেওয়া যেতে পারে অন্য একটা চাওয়াকে, চাহিদাকে! কীভাবে মুছে ফেলা যেতে পারে তার
সৃষ্টি, কৃষ্ঠি ও ঐতিহ্যকে। এরজন্য
সামান্য পদক্ষেপই যথেষ্ট। খুব নিপুণ ভাবে
জাতির সামনে তুলে ধরা হয় অন্য জাতিটির শ্রেষ্ঠতাকে... তার সফলতাকে... আর নদীর
একূলের মত ঝাপিয়ে গ্রহণ করবে সেই মনেহওয়া, ভেবে নেওয়া শ্রেষ্ঠত্বকে। কেননা, একটা
দৃঢ়চেতা জাতি গড়ে ওঠার পেছনে যতটুকু
মানসিক, অর্থনৈতিক এবং আবেগ,
অনুভূতির দরকার পড়ে তা দিতে পারে না, হয়ত কম দেয় সেই সমাজ, রাষ্ট্র। এটা এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতাও বলা
যেতে পারে। আর সেই নিরাপত্তা দিতে পারেনা বলেই সহজেই দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে যেতে চায়
অন্য একটা জগতে। নিজেকে প্রমাণ করার
আকাঙ্খা যেমন প্রাণী মাত্রই আছে, তেমনি অধিকার পেতে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে নিজের
লালিত-পালিত সত্ত্বাকেও মানুষ খুব সহজেই ভুলে যেতে পারে। নিজের মনে করে, নিজের ঐতিহ্যকে ফেলে আবার যখন সেই জাতি দেখে
নদীর ওকূলও আসলে ফাঁকা... তখন আবার
ফেরে... আবার ফেরে ভাষাটির কাছে... মাটির উঠোনের কাছে... ততদিনে অবশ্য পালটে যাবে
অনেককিছু... অনেকভাবেই... কিন্তু বেঁচে যাবে... ফেরে অবশেষে...
(কিন্তু এইসব লাগা না লাগা নিয়ে কখনোই পাল্টে যাওয়া
দেখিনি মায়ের । চুপচাপ আর চুপচাপ । ছোট্ট গ্রাম আমাদের । মাঠভর্তি রবিশস্য । পুবের
সূর্য ঢেলে দিচ্ছে কলসী ভর্তি আলোর দরজা । চাঁদ মায়া ছড়িয়ে রেখেছে ছাদময় । নদী নেই
। ধূধূ বিস্তারিত সংসার শিখছেন মা ।শরীরে আবহমানের সুখ। এক আশ্চর্য ব্যাপার নিয়ে ওইসব
আমার না- জন্মানো কালটা কে খুঁজে ফিরি । একা একা ওইসব নির্জন দুপুর , মা আর আমি , আমি
আর মা এক শরীর একাত্মা হয়ে চোখ তুলি মেঘের দিকে --- রোদের দিকে । একাকীত্ব ভরে কখনও
কখনও নাইতে যাই পৃথিবীর নির্জণতম ঘাটে । ভাবি , পৃথিবী কারো নয় । নিজস্ব কোন অনুধাবন
নেই তার। এই সমাযোজন প্রক্রিয়া বুঝতে বুঝতে কলেজ ক্যাম্পাসের বি. এড ক্লাস বেজে ওঠে
। মনোবিজ্ঞান আসলে মনকে কেটেছেঁটে দুটুকরো করার প্রণালী । রক্ত সেখানে ছাপার কালি ।
জন্মদিনের সুদৃশ্য রঙ ।তখন আধুনিকতার মোড়ক মুড়ে উন্মোচন হয় ভাষার সাথে এডজাস্ট । মানিয়ে
নেওয়ার হিউলেশন । সুর্বণরেখার জলে মায়ের শাঁখা বাজে ধীরে - সিঁদুর বাজে । আমার মেয়েজন্ম
তখন --
" জলকে আজকাল মায়ের মত
লাগে
আধারহীন, আকৃতিহীন "
অথবা
যে রেখা আমি চিনি না , যেখানকার
দিগন্তে আমার রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ভাসে না -- এই সীমানা কখনো আমার না । দৃশ্যের পর
দৃশ্য জুড়ে শুধু দৈনন্দিন উচ্চারণ , মৃদুমন্দের ব্যর্থতা আর কিছু নিঃসঙ্গতার
দেওয়াল ডিঙিয়ে এইসব চিরসত্য দেখি কেমন অলীকে পরিণত হয় । আমি তখন ক্লাস এইট । আমি
তখন কৃষ্ণচূড়া চিনি । তখন আমি প্রথম পিরিয়ড । লাল দাগে মানিয়ে নিতে নিতে মায়ের
আগলে রাখা শিখছি । বিছানার চাদর ভর্তি শুকনো রঙ সামলাতে সামলাতে শুনছি একুশের
মিছিল । ফাগুন জুড়ে ফ্রেবুয়ারি তখন । ফাগুন তখন স্কুলের পোস্টার । মায়ের আলতা শিশি
থেকে রঙ চুরি করছি । পোস্টারে আঁকছি রফিক সালাম বরকত এর নাম । পোস্টার এত লাল কেন
? অক্ষরে অক্ষরে রক্ত কেন !
আরও আরও শব্দহীন হোক এই উচ্চারণ । আরও বিস্তারিত হোক
এই লালের ফসিল । আরও কেঁদে উঠুক শহীদ মিনার, আসামের খানাখন্দ । পাহাড়ের গোপন হোলিখেলা
। বুক জুড়ে তখন রক্ত বমি । অ্যামেনিমা র ট্যাবলেট খেতে খেতে রক্ত সংগ্রাহকের ভূমিকা
যখন আমার হঠাৎই দেখি চোখে কেমন হলুদ সর্ষের ক্ষেত পেতে বসে আছেন মা । কপালে টগবগে সূর্য
বাবার জন্য , দশআঙুলের রেখায় সন্তানের বরাভয় পুষতে পুষতে আমার মায়ের চোখ চুরি করে নিয়েছে
সেই মাইথোলজির রাক্ষসী । বেদজ্ঞ পুরুষ শক্তি বলেছে যাকে । পুজো আসলে শত্রুকে ঈশ্বর
সাজানোর এক নিপুণ কৌশল ।
দেখি একদিন -- এইসব রক্তবমি সেরে আমিও কেমন মায়ের কাছে
ভীড়ে গেছি । মা আর আমি তখন সমবয়সী । কোন দেশ নেই , কাল নেই , ধর্ম নেই , লিঙ্গ নেই
। শুধু সন্তান আর মা । মা আর সন্তান ।
কিন্তু
জীবনের পর্ব জুড়ে শুধু কুহকের টান ।
শুধু রঙ রঙ খেলা । এইসব রঙের জাদুঘরে মা চিরকালীন এক আশ্রয়- -- ছায়াময় আশ্রম ।
প্রতিদিনের জমানো আত্মহত্যাগুলোকে এনে ছড়াই মায়ের আঁচলে । আদরে যত্নে মা বের করে
আনেন পুরোনো প্যাটরা , আলমারীর দেরাজ । এত জমানো কষ্ট নিয়ে মা আমার ঈশ্বরী হয়ে
উঠেন । হাতে বরাভয় , বামহাতে সন্তানের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন ---
"বাছা আমার কতদিন কাঙালের মতো বাড়ি বাড়ি ফিরেছে ! "
অথচ,
কাল অঝোরে কেঁদেছে আমাদের ভালো কথা
কিন্তু ,
ঈশ্বরের মন খুশী ছিল খুব
চিলেকোঠা ঘরে লুকিয়ে থাকা শৈশব
তুলে এনে নিজেকে রাজা ভেবে বসেছে
শৈশবের হাত ধরে দরজায় ঢুকছে আনন্দ
আনন্দের সাথে হারানো ভাষা , যে ভাষায় আমরা মাকে চিনেছি
প্রথম
উপায় না পেয়ে ঈশ্বরের পিছন পিছন ঘুরছি
আমিও
এতদিন পরে মা আলতা পায়ে পায়েস রান্না
করছেন
ঈশ্বর আর আমি উনুনের পাশে বসে ঝিমোচ্ছি
ভাষা লিখছি
আর তখনই...
এসো ভাষা... এসো আজন্ম বধির মূক
জ্ঞান... ইশারায়..
এসো হে নির্জন
সরল ব্যাকরণে...
আতপ চালের হাওয়া উড়ে যাই ধূসর দুপুরে
পেয়ারা ফুলের ঘ্রাণ
এসো জরা, এসো হে নিরোগ
এসো লাল রঙ...
ক্ষয়াটে সভ্যতা
ক্ষয়ে যাই আরও—
অথচ স্থির আর সহজ কার্তুজে
বুলেটিনে ছাপ রাখি
মায়ের অক্ষর...
ভাষায় ভাসাই এই অন্ধ নীড়... ছোট আলাদিন... ধুলোর সমীপে
বুকের ভেতর বাজে ঢিমিতাল অন্ধ মাদলের
ওপাশে আমানি, সামান্যই ফ্যানাভাত
ক্ষুধা তুলে দাও... আরও আরও লুব্ধকের
চেনাও জ্যোৎস্নার স্নান... দিঘির ছলাৎ
দূরের সবুজ মাঠ... রবিউল কাকাদের
বর্ণপরিচয় নিবিড় বন্ধুত্বে দেখো
চোখমুখ
হরিণী তন্দ্রায়
আবার ফিরেছে বাস... আবার ফিরেছে কথা
দুখিনী মায়ের জন্মভাষায়...
তাই যখন দেখছি, শুধু একটা ভাষার জন্য
গড়ে উঠছে, উঠতে চাইছে একটা দেশ... ভাষার জন্য লাল হয়ে যাচ্ছে বারাক
উপত্যকা... যখন ভাষার জন্য মানভূম চাইছে
শিখছে অধিকার --- তখন মনে হয় এই তো বেঁচে গেল ভাষা! এই তো বাংলা ভাষার
জয়জয়কার! কিন্তু যদি নিখুঁতভাবে দেখি, কেন
এই লড়াই, রক্তপাত? কেন সামান্য এক ভাষার জন্য একটা জাতিকে বিদ্রোহের পথে যেতে হয়!
তাহলে বুঝে নিতে হবে এই লড়াই আসলে বেঁচে থাকার, টিকে থাকার। তবে কী সেই জাতি ঝুঁকে
পড়েছিল অন্য ভাষায় ছড়ানো লোভের প্রতি? নাকি হাজার- বারোশো বছরে মধ্যে তৈরি হওয়া
একটা ভাষাগোষ্ঠী কী পারছিল না নিজের সমাজের মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করতে? বাংলাদেশের
ক্ষেত্রে অবশ্যই ছিল পাকিস্তানের,
অর্থাৎ রাজভাষা গ্রহণের
জোরজুলুম! তেমনি ছিল মানভূম কিংবা বারাক
উপত্যকায়ও। কিন্তু কেন? আবার যদি দক্ষিণে যাই, চিত্রটাই সম্পূর্ণ আলাদা... তাদের
২১শে ফেব্রুয়ারি নেই, নেই ১৯ শেও। প্রতিটি রাজ্যের ভাষা অথচ আলাদা। ওখানে গেলে
দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে তারা মানেনই না। বলেনও না প্রায়। নিজের
ভাষার প্রতি তারা খুব আবেগী। কেউ বুঝুক না বুঝুক নিজের মতো করে বাঁচার একটা নিজস্ব
ক্ষেত্র তারা তৈরি করতে পেরেছেন। তার জন্য যতটুকু মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন,
অর্থনৈতিক আনুকূল্যের প্রয়োজন, আবেগ যতটুকু থাকার কথা --- বলাবাহুল্য, তা তাদের আছে। শুধু নেই লোকদেখানি... তার মতো
হওয়ার বাসনা... কেননা তাদের হয়ত নদীর একটা কূলই আছে অপর কূলটাও তাদের প্রতিবেশি!
ফলতঃ অন্য ভাষাটিও তাদের জ্ঞাতি।
আর এখানেই একটা জাতির, একটা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব। আমাদের এই বাংলা ভাষা বিশেষ করে এই একহাজার
বছরে যতটা এগোতে পেরেছে, সাহিত্যে, জ্ঞানে, শিল্প সংস্কৃতিতে যতটা এগিয়ে চলেছে তাও
কী কম! এই যে একটা আস্ত দেশ তৈরি হয়েছে, এইযে একটা মাতৃভাষা দিবস তৈরি করতে
পেরেছে... তা কিন্তু কম কথা নয়। সুতরাং,
ভাষা হারালো, ভাষা হারালো --- শ্লোগান না দিয়ে, ভাষাকে ভাসাই সময়ের
স্রোতে... এই বরং ভালো!
অসাধারণ। এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আরো একটু পরিবর্ধন চাই
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা। পরিবর্ধনের চেষ্টা করবো ।
ReplyDelete