নিজস্ব ভাষার প্রতি, একা
মায়ের পেটের ভিতরেও আমার নিজস্ব
কোনও ভাষা ছিল না। পরিচয়ও ছিল না। দেশ ছিল না কোনও, কাঁটাতার ছিল না, বিদ্বেষ, ধর্ম,
জাতীয়তাবাদ কিছুই ছিল না। আমি জানতাম না জন্ম নিচ্ছি এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারে।
মায়ের পেটের ভিতরে আমার কোনও স্বপ্ন ছিল না। স্মৃতি ছিল হয়ত। সে স্মৃতির ভিতর জলে ডুব
দিয়ে সাঁতার কেটে কোথায় হারিয়ে যেত সাপ। একটি শিকারের জন্য গুঁড়ি মেরে অপেক্ষায় থাকত
ক্ষুধার্ত শ্বাপদ। সে স্মৃতির ভিতরে হয়ত মিশে যেত মাছ ও জলজ উদ্ভিদ। চাপ চাপ সেই অন্ধকারই
কি আমি প্রতিজন্মে দেখেছিলাম অমন? প্রতি মৃত্যুতে কি এই চাপ চাপ অন্ধকার আমাকে নিয়ে
যেত এক দীর্ঘকালীন ঘুমে? আমি বারবার জন্ম নিতে চেয়েছিলাম হয়ত। আমি বারবার জানতে চেয়েছিলাম
ঠিক কত বার আমাকে এই পৃথিবীর সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে হবে! এছাড়া আর কীই
বা চাওয়ার থাকতে পারে বলো। না, মায়ের পেটের ভিতরে তুমি ছিলে না। প্রেম নেই, যৌনতা নেই,
শুধু এক অন্ধকার আর স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসা কিছু ধ্বনি। সেই সব কথা, ধ্বনি, শব্দ যা
আমার কাছে মনে হত পৃথিবী। আকাশ ছিল না আমার কাছে। সবুজ ছিল না। নদী ছিল না বহমান স্রোত
হয়ে। মোহানার কাছে গিয়ে ছিল না নিজের বুকের মধ্যে অকারণ কেঁদে ওঠার মুহূর্ত। তোমার
বুকের মধ্যে যখন আমি মুখ গুঁজে দি, যখন তোমার শরীরের উষ্ণতার ভিতর আমার সমস্ত উল্লাস,
সমস্ত ধ্যান নিজেকে নিঃশেষিত করে, আমার কান্না পায়। মনে হয় এই মিলন যেন কখনও শেষ না
হয়। মনে হয় এই মিলনের ঋতুকালের শেষ নেই কোনও। মায়ের পেটের ভিতরে এই সব কিছুই ছিল না
আমার। সবুজের স্পর্শ পেতাম শব্দে, অহংকারের গন্ধ পেতাম শব্দে, ভালোবাসার প্রতিরক্ষা
পেতাম শব্দে, শব্দের মধ্য দিয়ে টের পেতাম ঝড় বয়ে গেলে কেমন হাওয়া বয়, শব্দের মধ্যে
দিয়ে আমার কাছে ছিটকে চলে আসত আলো। আহ, আলো, যার কথা আমি স্মৃতিতে দেখেছি। শব্দের মধ্যে
দিয়ে সে আমার চোখে হাত রাখত। শব্দের মধ্যে দিয়ে আকাশের নীরবতা তার সমস্ত নক্ষত্রের
আলো নিয়ে আমার চারপাশে গড়ে তুলত এক আশ্চর্য পৃথিবী। না, আমি দিনরাত জানতাম না, আমি
জানতাম না আলো আর অন্ধকারের কথা, জানতাম না
কত দূরে দূরে নিজেকে জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে ভাঙচুর করছে আকাশ। জানতাম না শূন্যতার
কোনও শেষ নেই। আমি ঈশ্বরের কথাও জানতাম না বিশ্বাস করো। মন্দিরের মধুর ঘণ্টাধ্বনি আমার
কাছে চলে আসত সঙ্গীত হয়ে। আমি মাকে চিনতাম না, বাবাকে চিনতাম না, জন্মকে চিনতাম না,
মৃত্যুকেও না। মায়ের পেটের ভিতরে আমি তোমাকেও ভালোবাসতে পারিনি। শূধু এক মহাশূন্যতার
ভিতরে আমি টের পেতাম নশ্বরতার জন্ম হচ্ছে। আমি নশ্বরতার কাছে হাত পেতে দিয়েছি। পেয়েছি
দুঃখ, জেনেছি শোক। বুঝেছি, মৃত্যুভয়। উপলব্ধি করেছি এই অনন্ত নশ্বরতার থেকে মুক্তি নেই!
কিন্তু সুষুপ্তি থেকে জাগরণ আছে। যেসব ধ্বনি ও শব্দবন্ধের আদিম প্রলয় পেরিয়ে আসছি,
জাগতে হবে তার আশ্রয়ে।বলে উঠছি,
আমাকে জাগাও।
হে আমার ভাষা, আমাকে জাগাও।
গভীর উচ্চারণ।
ReplyDeleteআহা!
ReplyDeleteআহা,তৃপ্তিতে ভরে ওঠা যায় এমন লেখা পড়ে।
ReplyDeleteআন্তরিক এই উচ্চারণ। এমন লেখাই তো চাই কবি- সম্পাদকের কাছে।
ReplyDelete