Wednesday, February 20, 2019

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে






"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়, একদম নয়। ওরা চব্বিশ ঘন্টা ভুল বোঝায়, চব্বিশ ঘন্টা বিপরীত কথা বলে। এই বলছে, আলোচনা করবে। এই বলছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে, কিন্তু হেলিকপ্টারে বন্দুক থাকবে। আবার বলছে, না, যদি নিচু থেকে গুলি ছোঁড়ে তা হলে বন্দুক থাকবে। এয়ারওয়াইজ মার্শাল বলছে, আড়াইশো পাউন্ডের বোমা মারব না, মারলে পাশের তিন-চারটা গ্রামের লোক মারা যাবে। ভাবুন, কত রকমের বিপরীতধর্মী কথা। আপনারা খুঁজুন, তথ্যের একেবারে টনটন হয়ে গেছে। এই সমস্ত কিছুর আবর্তে পড়ে আমরা একদম দিশেহারা। এই দিশেহারা মানুষের জন্যে কী দরকার? দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন মদের দোকান দরকার, সে রকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার। সোপ ওপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্লু-ফিল্ম দরকার। এগুলোর অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।
এই রকম করে আমাদের সমাজটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দের ইমপোর্ট ঘটিয়ে ব্যাপারটিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চিরদিন, বাংলায় বুদ্ধিজীবীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। রবীন্দ্রনাথ সিভিল সোসাইটি শব্দটা জানতেন না, জানার দরকার হয়নি। যখন দরকার ছিল, প্রতিবাদ করেছেন। আজকে হঠাৎ অ্যাংলো-অ্যামেরিকান কনোটেশনের একটা শব্দকে এখানে এনে—‘আমরা কি সত্যিই সিভিল সোসাইটি ?’ আরে ঘ্যাঁচুকলা, আমার কী দরকার সিভিল সোসাইটি হওয়ার? আমি আমার দেশের মানুষ, যে-ভাবে আমি ফিল করি, আমি বলব। আমরা কি সর্বক্ষেত্রে ওয়েস্টকে কপি করতে পারি? সিভিল সোসাইটি কী? সিভিল সোসাইটি, পশ্চিমি সংজ্ঞায় হচ্ছে, পারিবারিক স্যাংটিটির আলাদা জগৎ সেইটা এবং স্টেটের অফিসিয়াল জগৎ, এদের মধ্যে যারা থাকে। ঠিক আছে, ভাল কথা, আমাদের দেশে কি ভার্বেটিম সেগুলো হয়? আপনাদের কি মনে হচ্ছে, এই পরিবর্তনকামী এবং পরিবর্তনবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের দেখে, এদের ওপর সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব দেওয়া উচিত, না কি যায়? আপনারা এটা নিয়ে ভাবুন।

...কাজেই আজকে যে বড় লড়াইটার কথা কেউ-কেউ বলছেন, যে বড় লড়াইটা আমরা স্বপ্নে দেখি, সেই লড়াইটাকে মনে রাখতে হবে। ওয়ার্কিং ক্লাস একটা বড় রোল প্লে করবে, এবং তাতে এই যে গরিব— সে গ্রামের গরিব হোক, আর শহরের গরিব হোক— সবাই তার সঙ্গে যুক্ত হবে। তার সঙ্গে দরিদ্র কৃষক যুক্ত হবে, শহরের মধ্যবিত্ত যুক্ত হবে, এবং সেই দিন আসছে। সেই দিন, যে-দিন প্রত্যেকে আলাদা-আলাদা করে কোনো সুড়সুড়ির মজা পাবে না, যে-দিন প্রত্যেকের পিঠে একটা গরম ইস্ত্রি এসে পড়বে। সে দিনটা খুব দূরে নয়। এই চালের দাম বোধ হয় পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা হলেই বোঝা যাবে এটা কী দাঁড়ায়! এবং মনে রাখবেন, এই ঘটনা ব্রাজিলে হয়েছে, চিলিতে হয়েছে, আর্জেন্টিনায় হয়েছে, হাইতিতে হয়েছে, উরুগুয়েতে হয়েছে, গুয়াতেমালাতে হয়েছে। একটা দেশে পারেনি, খুব ভালো ভাবে করতে, নিকারাগুয়াতে। সেখানে একটু পিছু হটতে হয়েছে। ভেনেজুয়েলাতেও পারছে না। আর, কিউবাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই, আমাদের পক্ষেও তথ্য নেই, ইতিহাস নেই, রশদ নেই— এ রকম নয়। অনেক বেশি সাবধান হয়ে, অনেক আটঘাট বেঁধে আমাদের সামনের দিনটার কথা ভাবা উচিত। এই লড়াইটাকে কোনো মতে অর্থনীতিবাদের মধ্যে আটকে রাখলে হবে না। চে গ্যেভারা একটা কথা বলেছিলেন, আমার খুব ভাল লাগে এ কথাটা। বলেছিলেন, মানুষকে খাওয়ানো-পরানোটা যদি একমাত্র সমস্যা হয়, তা হলে একটা ইন্টেলিজেন্ট ফর্ম অফ নিও-ক্যাপিটালিজম ক্যান ডু ইট! এরা ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে, দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য নতুন মানুষ তৈরি করা, যে-মানুষ অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে। তা না হলে, মানুষ হয়ে বেঁচে কোনো লাভ নেই।"

- নবারুণ ভট্টাচার্য, ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনিলয়ে, ‘বিশ্বায়ন ও সন্ত্রাসবাদ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ‘মেদিনীপুর লেখক শিল্পী সমন্বয় মঞ্চ’। সেই সভায়, নবারুণ ভট্টাচার্য এই বক্তব্য রেখেছিলেন। সৌজন্যে ভাষাবন্ধন পত্রিকা। 



সম্পাদকমণ্ডলী-- হিন্দোল ভট্টাচার্য, সন্দীপন চক্রবর্তী, মণিশংকর বিশ্বাস বেবী সাউ শমীক ঘোষ
ঠিকানা- সি ৩/৬ কালিন্দী হাউসিং এস্টেট, কলকাতা-৮৯
লেখা পাঠানোর ইমেল আইডি-  abahaman.magazine@gmail.com 



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ