Wednesday, February 20, 2019

দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম





১.
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাশঘেষা একটি গ্রাম গ্রামের নাম রামরাইল পৃথিবীর যে কোন মাতৃভাষায় কথা বলবার দাবি উচ্চারিত হলেই এ গ্রামটি প্রাসঙ্গিক কারণ গ্রামে জন্মেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে দাবি রেখেছিলেন সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার যেহেতু পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত, বলেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের পক্ষ থেকে নাকচ এবং একটি ভাষার দাবি ক্রমশ একটা রাষ্ট্রের দিকে এগোয় গত কয়েকবছর হলো এ রামরাইল গ্রামের প্রবেশ মুখে একটি তোরণ নির্মিত হয়েছে, প্রতিবার এ তোরণটি চোখে পড়লেই এর অযত্ন অবহেলা চোখে পড়ে আর মনে আসে আমাদের মাতৃভাষারও কথা একইরকম, অনাদরে অবহেলায় ভিন সংস্কৃতির চাপে যে মাতৃভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর থেকে তার কি সঠিক হিসেব আছে! জানা নেই, তবে এটুকু সত্যি আজ পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাঙলা, একটু একটু করে চোখ রাঙানি সয়ে যাচ্ছে, আমাদের উদাসীনতা পরখ করছে অথচ একটি ভাষায় কথা বলবার দাবিতে জীবন দেয়ার ঘটনা এ ভাষাটির বাইরে বিরল ভাষার জন্য শাসকের বুলেট বুক পেতে নিয়েছে ঢাকা, নিয়েছে বরাক; যে ভাষা ধারণ করে আছে হাজার বছরের সংস্কৃতি, সে ভাষার বিপন্ন মুখ একটা চিন্তারেখার উদ্রেক করে বৈকি!

২.
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখের যে আলাদা আবেদন তা বাংলাদেশীমাত্রই জানেন যদি তার পড়াশুনোর পাঠ এদেশেই হয়ে থাকে রক্তশিমুল চারদিক ছেয়ে আছে, আর বিগত হতে যাওয়া শীতের গন্ধমাখা কোন এক ভোরে খালি পায়ে স্কুলের শহিদ মিনারে ফুল হাতে যাওয়ার যে অভ্যাস, তা কাউকে এর তাত্ত্বিক আর অনুভব অর্থে সেইসব দিনে কতটুকু শিখিয়েছে বলা কঠিন, কিন্তু দিনটির যে আলাদা মহত্ব আছে তা শিখিয়ে গেছে ভালোভাবেই আজও একুশের ভোরে ঘুম ভেঙে স্কুল বালক-বালিকাদের রাস্তায় সারি বেঁধে চলার যে দৃশ্য দেখা যায়, আর সারাদেশে মাইকযোগে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' যখন বাজে, এর পবিত্রতার সাথে তুলনীয় কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে যাওয়ার পর এই সকালের প্রস্তুতি আরো ব্যাপক হয়েছে, বিগত এক বছরে যশোর সীমান্তে এ দিনে অবস্থানগত কারণে দেখেছি দুবাংলা মিলিয়ে যে শ্রদ্ধাবনত মানুষের ঢল অনিকেত প্রান্তরে, তা সম্ভাব্য ভাষা-বিপন্নতার বিপরীতে একটা বিশাল সাহসও দেয় এবং এই যে স্কুল-পড়ুয়া আর সাধারণ মানুষের সারিতে অংশগ্রহণকারী মুখগুলো, তাদের নিয়ে একটা ধারণা প্রচলিত যে এরা কেবলই বাঙলা মাধ্যমে পড়ুয়া আর মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষ, তাতে কি আসে যায়, বাংলাভাষা তো চিরদিনই খেটে খাওয়া মানুষের ভাষা, ভাষাকে জিইয়ে রেখেছে কৃষক-মাঝি মাল্লা

শঙ্কা এবং আশার কথা বললাম বাঙলাভাষা তো এই বিপন্ন হবার থেকেই মাথা উঁচু করে ওঠা ভাষা বাংলাভাষার সমার্থক হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ এবং তার কর্ম কে ধর্মীয় বিভাজনের কত ফন্দিও তো দেখেছি, কিন্তু ভাষা, একইভাষার বুলির যে মধুর ঐকতান, তাকে রোখা কঠিন তাই আজ যখন পৃথিবীর বিভিন্নদেশে যেখানে বাঙ্গালী, যার উত্তরপ্রজন্মের হয়তো দেশে ফেরার সম্ভাবনাও নেই, তারা যখন ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাভাষা শেখান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা হয়, আর সাহিত্যচর্চার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে সারাবিশ্বেই বাঙলা কবিতা গল্প গান লেখা হয় তখন আরো বেশি সার্বজনীন বাংলাভাষার একটা গর্ব হয় বাংলাদেশ ভারত পার হয়ে সিয়েরালিওনে যে ভাষা আন্দোলিত করে সে ভাষার জনগোষ্ঠী যখন কাছে দূরে কোথাও কেবলমাত্র বাঙালী হবার কারণে আক্রান্ত হন, এ সংক্রান্ত সংবাদ যখন তরঙ্গে ভাসে, তখন একটা ভয় জাগে সত্যি, কিন্তু তার বিপরীতে বায়ান্ন একাত্তর একটা স্বপ্ন হয়ে কাজ করে  পরাজয় না মানার যে মন্ত্রে বাংলাভাষা চিরদিনের, সে ভাষার সন্তানেরা হেরে যাবে এমন তো ভাবতে পারি না



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ