Wednesday, February 20, 2019

চিকিৎসার ভিন্ন পাঠ... জয়ন্ত ভট্টাচার্য





চিকিৎসার ভিন্ন পাঠ, বর্তমান ভারতের জনস্বাস্থ্য এবং জ্ঞানতত্ত্বের সংগ্রাম  
আরোগ্য-নিকেতন ফিরে দেখা


প্রাককথন
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “আরোগ্য-নিকেতন” একটি উপন্যাস। প্রায় সমস্ত শিক্ষিত বাঙ্গালি পাঠকই এ উপন্যাস পড়েছেন। আমিও সেসব পাঠকদের একজন। চিকিৎসাবৃত্তি, চিকিৎসাব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ধরন নিয়ে লেখা এ উপাখ্যান – চিকিৎসার সেকাল-একাল হিসেবেও দেখা যায় এ উপন্যাসকে। আরো কতভাবেই তো দেখা যেতে পারে। এ উপন্যাস পড়তে গিয়ে ব্যক্তিজীবনে একজন চিকিৎসক এবং সমাজদর্শনের একজন ছাত্র হিসেবে আমার স্মৃতিতে ভিড় জমায় আরো অনেকগুলো আখ্যান, চিকিৎসার ইতিহাসের আরও কিছু অনুষঙ্গ।

New England Journal of Medicine বা NEJM-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (“Murmurs of Politics and Economics”, 27 September, 2018) আমেরিকা থেকে sub-Saharan আফ্রিকায় গিয়ে প্রবন্ধ লেখিকার এক মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। একজন রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজের রোগী ১২ বছরের ছেলে ৪ ঘন্টা হেঁটে এসেছিল একবার ডাক্তার দেখানোর জন্য। যে হাসপাতালে প্রবন্ধ লেখিকা নিকোলা লিলিচ গিয়েছিলেন কাজ করতে সেখানে একজন মাত্র চিকিৎসক রয়েছেন ২০ লক্ষ মানুষের পরিষেবা দেবার জন্যলিলিচ মনে করেন আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মেডিসিনের নানা প্রকরণ অত্যন্ত সুচারুভাবে, দক্ষতার সঙ্গে শেখানো হয়। শেখানো হয় কিভাবে মেডিসিনের তত্ত্বগত জ্ঞানকে ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসার পরিসরে যথাযথভাবে “contextualize” করতে হবে। কিন্তু শেখানো হয়না, আফ্রিকার অভিজ্ঞতার পরে লেখিকার মনে হয়েছে, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মেডিসিনের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক। কেন হার্টের অসুখ হয়েছে, কিন্তু চিকিৎসাও মিলবেনা –  শুধুমাত্র এ খবরটুকু জানার জন্য ৪ ঘন্টা হেঁটে আসতে হবে একটি ১২ বছরের ছেলেকে? উত্তর মেলেনা! প্রসঙ্গত, NEJM-এর impact factor ৭৯.২৫৮! মেডিসিনের জগতে অতি মান্য জার্নাল

২১ নভেম্বর, ২০১৮-তে NEJM-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের শিরোনাম – “Disease and Famine as Weapons of War in Yemen” প্রবন্ধটি শুরু হচ্ছে এভাবে – How can the medical community take stock of the humanitarian disaster in Yemen? কিভাবে পৃথিবীর মেডিক্যাল সমাজ ইয়েমেনে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার বিবেচনা করবে?
কোথায় ইয়েমেন? মধ্য এশিয়ার একফালি দেশ – রেড সি, আরব সাগর এবং সৌদি আরব দিয়ে ঘেরা। ২০১৬ থেকে ইয়েমেনের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, জীবনহানি, শিশুমৃত্যু, অনাহার, দুর্ভিক্ষ, কলেরার মতো মহামারী প্রত্যক্ষ করছে। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ চলছে। কেন চলছে?
উত্তর মেলেনা! উত্তরতো কতকিছুরই মেলেনা। বলা ভালো মেলে কম ক্ষেত্রে।
NEJM-এর লেখাটিতে ফিরে আসি। লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা জানছি ২০১৮-র অগাস্ট মাসে একটি স্কুল বাসের ওপরে সামরিক বিমান হানায় ৫০ জনেরও বেশি খুদে স্কুল ছাত্র মারা গিয়েছে। কিন্তু ঘটনাসগুলির প্রায় কোন প্রচার নেই। প্রবন্ধের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী, “বর্তমানে যে পরিমাপের সংকট চলছে ইয়েমেন তার তুলনায় করুণভাবে এ নিয়ে প্রায় কোন রিপোর্ট নেই” এরপরে প্রবন্ধে একটি অমোঘ মন্তব্য রয়েছে – “এরকম অবহেলা আমাদের সম্মিলিত সংবেদনশীলতা যে বিবশ হয়ে পড়েছে (numbing of our collective sensitivity) তা বড়ো দগদগে করে দেখায়।” কোথায় রাখবো আমরা মানবাত্মার এবং আমাদের মরমী অস্তিত্ব ভুলুন্ঠিত হবার অপমান? একই ঘটনা কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইরাকে দেখেছি, দেখেছি সিরিয়াতে, দেখেছি আফগানিস্তানেআমাদের যাপনে আর চৈতন্যে এভাবে হয়তো কষাঘাত করেনি – পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন!
মেডিসিন বা চিকিৎসার প্রেক্ষিত থেকে কি কি ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে ইয়েমেনে? উল্লেখিত প্রবন্ধ অনুযায়ী সৌদি আরব, আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সম্মিলিত সামরিক আক্রমণে হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ও স্বাথ্য পরিষেবা দেবার বিভিন্ন আস্তানা বা প্রতিষ্ঠান প্রায় সম্পূর্ণত ধ্বংস হয়েছে – বহুক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করা হয়েছে। Medecins sans Forntiéres বা MSF (মেডিসিন উইদাউট বর্ডার তথা সীমানা ছাড়িয়ে মেডিসিন) বিশ্বব্যাপী সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে – “যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম ৭ মাসের মধ্যে এমএসএফ-এর ৩৭টি হাসপাতালে বোমা ফেলা হয়, যদিও অনেক আগেভাগেই এগুলোকে চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে এদের সবার জিপিএস (GPS) অবস্থান সৌদি কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল” কি দাঁড়ালো তাহলে বিষয়টি? আন্তর্জাতিকভাবে রেডক্রশ-তুল্য গুরুত্বপূর্ণ এরকম একটি মেডিক্যাল সংগঠন আক্রমণকারী ঘাতকবাহিনীকে তাদের হাসপাতাল এবং মেডিসিন কেন্দ্রগুলোর অবস্থান GPS-এ আগাম জানিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বোমাবাজির হাত থেকে বাঁচেনি। আরো উল্লেখযোগ্য, ১১ জুন, ২০১৮ MSF-এর একটি কলেরা চিকিৎসাকেন্দ্র সৌদি আরবের নেতৃত্বে হামলাকারী যুদ্ধবাজেরা উড়িয়ে দিয়েছে। খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ল্যান্সেট পত্রিকার ১৪ জুলাই, ২০১৮ সংখ্যায় “Devastation in Yemen ongoing” শিরোনামে। শুধুমাত্র এটুকু নয়, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রশ বা ICRC-র একজন সদস্য ওদের আক্রমণে নিহত হবার পরে ICRC তাদের ৭১ জন স্টাফকে তুলে নিয়েছে

কে দেবে চিকিৎসা? MSF আক্রান্ত, আক্রান্ত ICRC, আক্রান্ত চিকিৎসা দেবার সমস্ত সংগঠন NEJM-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে পরিষ্কার মন্তব্য করা হচ্ছে – “বোমাবাজি এবং অবরোধের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার কাছে পৌঁছুনোর রাস্তা প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হবার পথে। এর দরুণ, রেখেঢেকে বললে অপ্রতক্ষ্যভাবে আর খোলাখুলি বললে প্রতক্ষ্যভাবে, রোগের সংক্রমণ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে (weapons of war) ছড়িয়ে পড়ছে” কি অসম্ভব এক পরিস্থিতি! চিকিৎসাকেন্দ্রের উপর আক্রমণ, সাধারণ মানুষ যারা কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই যুদ্ধের বলি তাদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছনোর সমস্তরকমের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া এবং সরাসরি চিকিৎসকদের মেরে ফেলা – ছড়িয়ে দিচ্ছে সংক্রামক ব্যাধি, যেমন কলেরা, এবং অন্যান্য সংক্রমণ। সংক্রমণ ঘটানো হয়ে উঠছে weapons of war বা যুদ্ধের হাতিয়ার। ইয়েমেনের সমগ্র বিষয় নিয়ে MSF একটি রিপোর্টও তৈরি করেছে – “Yemen: Healthcare under Seize” UNICEF-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হেনরিয়েটা ফোর ৩ জুলাই, ২০১৮-তে একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানান – “There is no justification for this carnage (এরকম নরহত্যার কোন কৈফিয়ৎ হয়না)”

NEJM-এর উল্লেখিত প্রবন্ধটি জানাচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে নরহত্যার সামরিক সমন্বয়কে আমেরিকা সাহায্য করছে বিভিন্নভাবে – ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র বিক্রী করে, সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং উড়ন্ত অবস্থায় বিমানে জ্বালানি ভরার ব্যবস্থা করে দিয়ে। পরিণতি? – “ইয়েমেনের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসাকেন্দ্র এবং জল-পরিশোধনব্যবস্থা দুটির ওপরেই বারংবার বোমাবাজি করা হয়েছে। একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে কেবলমাত্র কর্তৃত্ব কায়েম করার জন্য সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে পরিস্রুত জল সরবরাহের ব্যবস্থাও। কি অপরাধ এখানকার সাধারণ মানুষের? কাশ্মীরেও সমধর্মী অভিজ্ঞতা কাশ্মীরীদের। বাশারাত পীরের লেখা Curfewed Night-এ ওখানকার অবস্থার নিরাবেগ, বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। পীরের মন্তব্য – “elegance is granted little space in an age of wars”
ইয়েমেনে পরিস্রুত জল সরবরাহের ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবার ফলশ্রুতিতে ২০১৭-র জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত কলেরা ছড়িয়েছে মহামারীর মতো। ৯৬০,০০০-র বেশি মানুষ কলেরা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২২১৯ জনের। আজ ভারতবর্ষে বা ইউরোপের কোন দেশে কিংবা আমেরিকায় যদি ১০ লক্ষের বেশি মানুষ কলেরা আক্রান্ত হত এবং ২ হাজার মানুষ মারা যেত তাহলে কি হত? কতোটা হুল্লোড় হত? মিডিয়া কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো? খেয়াল রাখবো আমাদের আলোচিত প্রবন্ধের শুরুতেই আমাদের বিবেককে ভৎর্সনা করা হয়েছে “আমাদের সম্মিলিত সংবেদনশীলতার বিবশ হয়ে যাওয়া নিয়ে (numbing of our collective sensitivity)”

“এ আমার, এ তোমার পাপ”। তা ঘটুক এখানে কিংবা ইয়েমেনে। ১২ অগাস্ট, ২০১৭-তে ল্যান্সেটে প্রকাশিত “Yemen and cholera: a modern humanity test” শিরোনামের প্রবন্ধে জানানো হল ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ৩ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক ১.৪৫ কোটি মানুষের কাছে “পরিচ্ছন্ন জল এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের কোন পথ খোলা নেই রাষ্ট্রপুঞ্জের (UN) তরফে বলা হয়েছে “বিশ্বের নিকৃষ্টতম মানবিক সংকটের প্রেক্ষিতে কলেরার ভয়ঙ্করতম প্রাদুর্ভাব পৃথিবীর সবচেয়ে কদর্য একটি ঘটনা” ইয়েমেনে এই মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্যপরিষেবার প্রায় ৫০% সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা একটিবার আমাদের দেশকে এ অবস্থানে রেখে কল্পনা করে দেখি এ অবস্থা!

এরকম এক পরিস্থিতিতে আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে হ্যাফডান ম্যালারের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাশিয়ার আলমা-আটা-য় গ্রহণ করা Declaration of Alma-Ata – International Conference on Primary Health Care” বা “বিশ্ব স্বাস্থ্য সনদ”-এর কথা যেখানে প্রথম WHO-র তরফে বিশ্ববাসীর সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের যত্ন বা স্বাস্থ্যব্যবস্থা (comprehensive primary health care) সুনিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান গৃহীত হয়েছিল। আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল – পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মানের স্বাস্থ্য ২০০০ সালের মধ্যে অর্জিত হতে পারে, যদি পৃথিবীর সম্পদকে পরিপূর্ণ চেহারায় আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। এ সম্পদের এক বড়ো অংশ এখন ব্যয় করা হয় সমরসম্ভার গড়ে তুলতে এবং যুদ্ধের জন্য। আন্তরিকভাবে স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া (détente) এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি প্রণয়ন অতিরিক্ত সম্পদ উৎপাদনের রাস্তা উন্মুক্ত করবে। এ সম্পদসম্ভারকে ব্যবহার করা সম্ভব আর করা উচিৎও শান্তির লক্ষ্যে এবং বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, যার মধ্যে একটি আবশ্যিক অংশ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এর অংশ দিতে হবে।”
অস্যার্থ, পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে এবং এজন্য স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে
১৯৫০-৭০-র দশক জুড়ে বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরু বিশ্বের জীবন্ত উপস্থিতি ছিল। প্রবল পরাক্রান্ত, আগ্রাসী ও মুক্ত পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো ভিন্ন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব – সমাজতান্ত্রিক বলে যার উপস্থিতি ছিল জনমানসে। দ্বিমেরু বিশ্বের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল যাকে বলতে পারি “তৃতীয় পরিসর”। বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক আশা-আকাঞ্খা এবং দাবী নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা বেশি ছিল। পরবর্তীতে একমেরু বিশ্বের উদ্ভব এসবকিছুকে পরিপূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয় – আজকের ভারত এর একটি প্রোজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। এ সময়েই পৃথিবী জুড়ে শ্লোগান উঠেছিল – স্বাস্থ্য আমার অধিকার। আবার অন্যদিকে তাকালে প্রান্তিক অশিক্ষিত বুভুক্ষু মানুষের কাছে শিক্ষা এবং বই পৌঁছে দেবার আন্দোলন, শিক্ষার অধিকারের আন্দোলন জনচেতনায় চেহারা নিচ্ছিল। এর উদাহরণ লাতিন আমেরিকায় পাউলো ফ্রেইরে-র আন্দোলন। আমরা যেন ব্রেখটের সেই বিখ্যাত উক্তির অনুরণন শুনতে পেলাম পরবর্তী সময়ের এ আন্দোলনে – “ভুখা মানুষ বই ধরো, ওটা তোমার হাতিয়ার”।

১৯৭৮-এ আলমা-আটার জনস্বাস্থ্য সম্মেলন বলতে চেয়েছিল – সকলের জন্য স্বাস্থ্য যার ফলিত চেহারা হবে “comprehensive primary health care” এর সাথে কোন আপস নয়। কোন “selective primary health care”, নয় কোন universal health coverage, নয় কোন ইন্সিউরেন্স দানবের দাপাদাপি। স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার যা আমাদের সংবিধানে হাজারো লড়ায়ের পরেও ৬টি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
১৯৭৮-এ আলমা-আটার ঘোষণায় সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছিল - পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে এবং এজন্য স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেবার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”-এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ প্রায় সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে সেরকম এক সময়ে অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল প্রয়োজনীয় ৯ পৃষ্ঠা।
অল্পকথায়, জনস্বাস্থ্যের কিংবা জনতার স্বাস্থ্যের দর্শন একটি বহুল পরিমাণে ভিন্ন অবস্থান। এটা কোন একক ব্যক্তিকে পণ্য হিসেবে বিক্রী করা চকমকে মোড়কে মোড়া “finished product” স্বাস্থ্য পরিষেবা বা “হোল বডি চেক আপ” নয়, মেডিক্যাল শিক্ষার বুদবুদের বাজার নয় বা এখানে কোন লুকনো শিক্ষাক্রমও নেই। এখানে সবকিছুই অবারিত খোলা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমস্টিকে। এখানে টিবির মতো নিঃশব্দে মারণান্তক রোগের বাস, কৃমিতে ক্ষয়াটে চেহারার সমাহার, এখানেই থাকে আন্তর্জাতিক জগতে আলোচিত “tropical neglected diseases” – যার জন্য ব্যয়বরাদ্দ কিছু নয় বললেও বেশি বলা হয়। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত social psyche, একদিকে clinical health public health; অন্যদিকে, health এবং হেল্‌থ কেয়ার-এর মধ্যেকার প্রভেদ মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর। এরকম এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে আমরা আবার পাঠ করছি “আরোগ্য-নিকেতন”।

দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানী এবং হিংস্রতম, আগ্রাসী কর্পোরেট পুঁজির কাছে মানুষ শব্দটির ততক্ষণই মূল্য আছে যতক্ষণ সে মুনাফা দিতে পারে। এজন্য ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা, দেহ ও মন থেকে অসুস্থতাকে বিযুক্ত করে দেখে কেবলমাত্র অসুখের জন্য সমস্ত ওষুধ ও প্রযুক্তি তৈরি হয়ে চলছে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য, মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমও বিপুল্ভাবে প্রভাবিত হয় ৩০ লক্ষ ইয়েমেনী কিংবা ইয়েমেনের একটি প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এ দানবদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়।
মেডিসিনের মানুষমুখী, মানুষের রোগ-মুখী নয়, হয়ে ওঠার জন্য আমরা পুনরায় পাঠ করছি “আরোগ্য-নিকেতন” ২০১৯ সালে! আরোগ্য-নিকেতন উপন্যাসে জনস্বাস্থ্যের কথা নেই, বরঞ্চ রয়েছে ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসার কথাই। কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র জীবন মশায় এবং তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষেরা এমনভাবেই সমাজে নোঙ্গর ফেলে আছে যে সমাজ-স্থিত ব্যক্তির চিকিৎসার মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যেরও একটি রেখাচিত্র, inchoate চেহারা ধরা পড়ে।
উপন্যাসের আখ্যানে ধরা পড়ে গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া কলেরার সময় অনুজ কিশোরের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননা আমাদের জীবন মশায় – যদিও তাঁর নিজের সক্ষমতা নিয়ে দ্বিধা তাঁর সঙ্গী। উপন্যাসের বয়ানে –
“বেশ যাব। তুমি ডাক দিলে – নিলাম সে ডাক।“
“সেইবার কলেরার সময় ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন ইঞ্জেকশন দেখেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যেই কলকাতা থেকে মেডিক্যাল ভলানটিয়ার্স এসে উপস্থিত হয়েছিল। একদল সোনার চাঁদ ছেলে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে এল লোকজন। স্যানিটারি ইনস্পেকটর। আর একদল, কী নাম যেন তাদের? কোদালি ব্রিগেড! কোদাল ঘাড়ে করে এল শিক্ষিত যুবকেরা।
শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারুর মনে হয় নি! স্যানিটারি ইন্সপেকটারেরা পুকুরে পুকুরে ব্লিচিং পাঊডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন দিলে। কলেরার টিকে!
সব থেকে বিস্মিত হয়েছিলেন – স্যালাইন ইনজেকশন দেখে।”
আহা! এমন একটি নিবেদিত-প্রাণ, মানুষের মাঝে-থাকা চিকিৎসক যদি আমরা হতে পারতাম। কিংবা হাতের নাগালে পেতাম প্রতিটি যাপনের মুহূর্তে! জীবন মশায় এবং প্রদ্যোত দুটি সত্তা মিলে গিয়ে আমার মাঝে যদি এমন একটি চিকিৎসক সত্তার জন্ম হত! মানুষের বেঁচে থাকার, আরেকটু উজ্জ্বল জীবনের এরকম স্বপ্ন দেখতে নিষেধ কোথায়? স্বপ্নের কি কোন দেশ, সীমা, কাল, জাত হয়?
হয়তো বা হয়ও। বর্গের বিভাজন ঘটে। স্বপ্নে ছবি আসে প্রাণময়, সতেজ, সজীব, আয়ুষ্মান মানুষের – আয়ুষ্মান ভারতের নয়, ভারতের প্রতিটি মানুষের। অরণ্যের প্রতিটি বৃক্ষের স্বাধীনতার মতো।
কথার কথা
আরোগ্য-নিকেতন নিয়ে আজ ২০১৯ সালে একজন চিকিৎসকের অবস্থান থেকে নতুন করে পাঠ করার মাঝে এক যুক্তিঋদ্ধ বৌদ্ধিক আনন্দ আছে। কিছুটা ঝুঁকিও আছে। আবার রল্যাঁ বার্ত-র “The Death of the Author” – এ পটভূমি মাথায় রাখলে আমাদের মূল ভাবনার সাথে আরেকবার ফিরে দেখা যায় আরোগ্য-নিকেতন-কে ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে যে লেখা বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, ২০১৯ সালে একে ফিরে পড়তে গেলে ৬৬ বছর সময়ের ব্যবধানে চিকিৎসার বোধে, সাহিত্য ও সমাজ-সংস্কৃতির পরতে পরতে যেসব পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবীভাবে ঘটেছে আলোচনার সময় সেসবের ছাপ তো জড়িয়ে ধরে থাকবেই এ ছাপগুলো লেখকের কলম থেকে যে অমূল্যসম্ভার সৃষ্টি হয়েছে তা লেখকের মৃত্যু ঘটায়না বোধকরি। পাঠকের মনে তৈরি হওয়া ছাপও লেখককে নতুন করে বুঝে নেবার, চিনে নেবার এক একটি নতুন বাঁক, গবাক্ষ। বালজাক-এর লেখা পাঠ করতে গিয়ে বার্ত-র মনে হয়েছিল – লেখক কি কোন সার্বজনীন প্রজ্ঞা (“universal wisdom”) বা রোম্যান্টিক মনস্তত্ব (“romantic psychology”)-র কথা বলছেন? বালজাক কি বলতে চেয়েছিলেন, বার্ত-র মতে, আজ আর বোঝার উপায় নেই। এখানে বার্ত-র ধারণানুযায়ী একটি স্বরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে “several indiscernible voices”সাহিত্যর ধর্ম বা আরব্ধ কাজই হল এই অশ্রুত, না-দেখতে পাওয়া স্বরগুলোকে আবিষ্কার করা।
এখানে দুটো বিষয় চলে এলো – প্রথম, বালজাকের মতো সাহিত্যিক কি কোন সার্বজনীন প্রজ্ঞার কথা বলেছেন? সে উত্তর পাবার অবস্থা নেই। কিন্তু আমাদের তারাশঙ্কর তাঁর উপন্যাসে কোন সার্বজনীন প্রজ্ঞা বা “universal wisdom”-এর বার্তা দেননিপ্রায়-নিরাসক্ত ভঙ্গীতে বর্ণনা করেছেন কিভাবে চিকিৎসার এবং রোগকে বোঝার একটি জ্ঞানতত্ত্ব হেরে যাচ্ছে, জায়গা করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চিকিৎসার এবং রোগকে বোঝার উদীয়মান নতুন জ্ঞানতত্ত্বকে। হয়তো এর মাঝে একটি সার্বজনীনতা আছে। কিন্তু তার সাথে তীব্রভাবে জড়িয়ে আছে পারস্পরিক মানব সম্পর্কগুলোর মাঝে (যার মাঝে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কও আছে) ছড়িয়ে থাকা, অন্তর্লীন হয়ে থাকা গভীর বিশ্বাস, নাড়ী ছিঁড়ে যাবার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। দ্বিতীয়, পাঠকের কাছে তারাশঙ্কর কাহিনীর বুনটের মাঝে বুনে দেন “indiscernible voices”-এর শ্রাব্য রূপ, পাঠকের কল্পনায় জীবনের চলচ্ছবি এঁকে দেন।
এ উপন্যাসে একটি বিশেষ স্থান নিয়ে আছে মৃত্যুমৃত্যু অনেক ক্ষেত্রেই এখানে যে পটভূমিতে জীবনের কথা, বেঁচে থাকার কথা, মানুষের তথা রোগীর কথা বলা হয় সে পটভূমিতে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যু এখানে শিল্পীর ক্যানভাসের মতো কাজ করে। এ কারণে এ উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বহু পাঠকেরই মনে পড়বে আরেকটি যুগান্তকারী সৃষ্টি তলস্তয়ের The Death of Ivan Ilych-এর কথা। কিন্তু দুটির মাঝে মৌলিক পার্থক্য আছে ইভান ইলিচ একজন ব্যক্তি, কেবল একজন ব্যক্তি হিসেবে, যার সাথে পরিবার সমাজ কোনটাই নেই, নিজের রোগ-যন্ত্রণা, অসহনীয় কষ্ট বহন করে ইলিচ ক্রম-বিকশিত অণুসত্তার জন্ম দেওয়া সমাজের সন্তান বা victim. বিপরীতে আরোগ্য-নিকেতনের কেন্দ্রীয় চরিত্র জীবন মশায় মানুষের বহমান, যাপ্য জীবনের মাঝে সমাজ-স্থিত একজন ব্যক্তি যিনি প্রতিটি পলে অণুপলে মানুষের মাঝেই থাকেন, এর পরম আনন্দময় উপস্থিতি অনুভব করেন। বিপরীতে ইভান ইলিচের রোগাক্রান্ত পরিস্থিতির কঠোর মুহূর্তে – “He wept on account of his helplessness, his terrible loneliness, the cruelty of man, the cruelty of God, and the absence of God.”

তার কাছে কোন ঈশ্বর নেই, কোন চিকিৎসক নেই পাশে দাঁড়ানোর জন্য, নেই কোন বান্ধব। ১৮৮৬ সালে লেখা ইভান ইলিচের গল্পের সাথে আরোগ্য-নিকেতনের সময়ের পার্থক্য ৭০ বছরের। ১৮৮০-র শেষভাগে কম উন্নত বা কৃষি-অর্থনীতি নির্ভর রাশিয়াতেও ”একক ব্যক্তি”-র বা individual-এর আবির্ভাব ঘটে গেছে। ১৯৫৩-র বাংলায় মানুষ ও জীবন মশায়ের মতো অনেক অনেক চিকিৎসক সমাজিকভাবে প্রোথিত। মশায়ের রোগীরাও সামাজিক মানুষ, একক ব্যক্তি নয়। নতুন শবব্যবচ্ছেদ ও হাসপাতাল-নির্ভর আধুনিক মেডিসিন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো অনেক আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে এই ব্যক্তিক মানুষের সামাজিক উন্মেষ সম্ভব করে তুললো, বিশেষ করে নাগরিক ভারতে। ঐতিহাসিক ডেভিড আর্নল্ড আমাদের জানান যে  ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে উপনিবেশিক পশ্চিমী শাসনের অবসানের পরে পশ্চিমী চিকিৎসা  যে অভূতপূর্ব মান্যতা অর্জন করেছে ভারতবর্ষে এর আগে তা কখনো ঘটেনি এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! (ডেভিড আর্নল্ড, “The rise of Western medicine in India”, Lancet (348) 1998, পৃঃ 1075-1078)

এখানে আরো দু-একটি কথা বলে নেবার প্রয়োজন আছে প্রাক-১৯৪৭ সময়ে তো বটেই এবং স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৪৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর Constituent Assembly-তে আধুনিক চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদ নিয়ে পি ধুলেকর (তৎকালীন যুক্ত প্রদেশের জেনেরাল) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন  - I wish to submit that the word “medical” that is being used in India for some time past has been laying too much stress on the medicinal side, of the health problem of this country. The word ‘medical’ is a misnomer.
তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য ছিলো - It simply means medication and therefore we have come to a position when we feel that the administration of the medical department could only be seen and looked at from the point of view of what medicines are useful in the country. এ বক্তব্যে লক্ষ্য করার যে ধুলেকর ইউেরাপীয় চিকিৎসার মাঝে অন্তর্নিহিত বিপজ্জনক medicalization নিয়ে আপত্তি জ্ঞাপন করছেন
তাঁর বক্তব্যে আরো ছিলো - I would submit, Sir, that having studied the medical question from different points of view, I have come to the conclusion that it is the duty of the State to see that every individual, every human being who possesses of body, must know something about the preservation, protection and prolongation of life. The word “medical” is a wrong word. I would submit that the word in India was Ayurveda, science of life.
ধুলেকরের বক্তব্যের মাঝে আয়ুর্বেদের – যার প্রকৃত অর্থ আয়ুকে বোঝার বা আয়ুস্মান হবার জ্ঞানশাস্ত্র (science of longevity) – দর্শনের ছাপ আছে। ১৯৪৭-এর আশেপাশে এ ছাপ থাকাই স্বাভাবিক।

কিন্তু এসব আলোচনা ধোপে টেকেনি যদিও এটা এখন গৃহীত সত্য যে ১৯৪৭-এ ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে যাবার আগে একটি পরস্পর-বিরোধী স্বাস্থ্যের প্রবণতার জন্ম দিয়েছিলো প্রতি ৬৩৩০ জন ভারতবাসীর জন্য তখন একজন মাত্র আধুনিক  চিকিৎসক ছিলো (যখন ইংল্যান্ডে এ অনুপাত ছিলো প্রতি ১০০০ জনে ১ জন) এরকম পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আর্নল্ড-এর বক্তব্য বুঝতে হবে - Nor was India completely converted to allopathy. Even in the 1920s and 1930s there remained a far larger number of practitioners of the “traditional” systems of Indian medicine (principally Āyurveda and Unani) than of western medicine. The latter's failure to penetrate large areas of the countryside was one factor in this; no less important was the preference for a more familiar system of medicine and a way of understanding disease, health, and the body that was perceived to be more effective, sympathetic, or simply cheaper. (আর্নল্ড, পূর্বোক্ত)


১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জীবন মশায়ের কার্যক্রম। কিন্তু সেসময়ে যে বিতর্কগুলোর কথা এখানে আলোচিত হল তার রেশ শেষ হয়ে যায়নি, বরঞ্চ বহাল তবিয়তে আছে।

আরোগ্য-নিকেতন নিয়ে বিভিন্ন স্তরে, পরতে পরতে আলোচনা করা যায় তন্নিষ্ঠ পাঠক, সমালোচক, গবেষক এবং আরো অনেকে তা করেওছেন। এ আলোচনায় আমরা কেবলমাত্র সীমায়িত থাকবো চিকিৎসক জীবন মশায়, তাঁর চিকিৎসা, সমষ্টি মানুষের সাথে তাঁর ঘন-পিনদ্ধ একান্ততা এবং নবীন, আধুনিক মেডিসিনের চিকিৎসক প্রদ্যোৎ-এর মধ্য দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা ও এর প্রকরণের যে আবির্ভাব তার সাথে মশায়ের সম্পর্ক কিভাবে বিবর্তিত, নির্মিত ও চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছেছে (এক অর্থে catharsis-ও বটে) শুধুমাত্র সে পরিসরটুকুতে। এ পরিসরেও পাঠের অমোঘ নিয়মে পাঠকের নতুন ব্যাখ্যা, অনুসন্ধানের নতুন সুলুক-সন্ধান এসে মিলবে।
           
উপন্যাসের গোড়ার দিকে যখন ক্রম-ব্রাত্যায়িত জীবন মশায়ের সাথে আধুনিক চিকিৎসার সংঘাতের ক্যানভাস রচিত হচ্ছে সে সময় সাধারণ প্রদ্যোতের চোখ দিয়ে মানুষের চোখে মশায়ের বর্ণনা দিচ্ছেন লেখক –
“সে আমলের ডাক্তার, তাও পাস করা নয়। আসলে হাতুড়ে। এখনকার চিকিৎসায় কত উন্নতি হয়েছে। সে সবের কিচ্ছু জানে না।
কেউ কেউ বলে গোবদ্যি।”
           
এখানে এসে একটু পেছনে তাকানো যায়১৭৯৯ সালে H. P. Forster-এর A Vocabulary, in two parts, English and Bengali and vice versa প্রকাশিত হল। Vocabulary-র ২য় খণ্ড প্রকাশিত হল ১৮০২-১ম খণ্ডে “গোবধ্যা” শব্দটির উল্লেখ আছে। ইংরেজি প্রতিশব্দ দেওয়া আছে Quack doctor – [ ] ১ম খণ্ডে Surgeon-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আছে অস্ত্রবৈদ্য, আসুরিচিকিৎসক, ঘার রোজা, ঘায়েরওঝা –  ২য় খণ্ডে অস্ত্রবৈদ্য অর্থে surgeon-এর ব্যবহার করা হয়েছে –  আয়ুর্বেদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে আছে (২য় খণ্ড) Physic (the Science) –
বেশ কৌতুহলজনক যে দুটি খণ্ডের একটিতেও অ্যানাটমি শব্দটি নেই, এমনকি dissection-এরও উল্লেখ নেই। একটি ভোকাবুলারি বা ডিকশনারি যদি একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে বিচরমান শব্দাবলীর সমাহার বোঝায় (এবং বাস্তবেও এটাই ঘটে), তাহলে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় ইংরেজদের নিজদেশে আহরিত অ্যানাটমি বা ডিসেকশনের জ্ঞান ও এর জন্য ব্যবহৃত উপযুক্ত শব্দ এদেশের শব্দাবলীর জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেনা। আমাদের আলোচিত উপন্যাসে দেখবো কেবলমাত্র এই দুটি বিশেষ বিষয়ের ওপরে দখল কিভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞানের সিংহাসন দখল করেছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
উপন্যাসের কথা
১৯৫৬ সালের ১৩ আগস্টে (এ উপন্যাসের ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হবার পরে) ব্যোমকেশ মজুমদারকে একটি চিঠিতে তারাশঙ্কর জানিয়েছিলেনজীবন মশায় বাস্তবে ছিলেন কি না প্রশ্ন করেছেন ছিলেন তাঁকে দেখেছি, তাঁর ওষুদ খেয়েছি এবং যেসব রোগী ও রোগের কথা লিখেছি তার পনের আনাই সত্য। …. কিশোর যার নাম তার বাল্যবয়সটায় আমিই কিশোর(রচনাবলী, ১০ম খণ্ড)
প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানশাস্ত্র অনুযায়ী প্রত্যক্ষ তথা অধুনা অ্যকাডেমিক আলোচনায় ব্যবহৃত শব্দ যাকে বলে embodied experience সেখান থেকে যাত্রা শুর উপন্যাসের। একারণে আরও পাঁচটা উপন্যাসের সাথে আরোগ্য-নিকেতনের পার্থক্য বিভিন্নক্ষেত্রেই পরিস্ফুট হয়। উপন্যাসের উন্মোচন হচ্ছে এভাবে –

আরোগ্য-নিকেতন অর্থাৎ চিকিৎসালয়। হাসপাতাল নয়, দাতব্য চিকিৎসালয়ও নয় …. দেবীপুর গ্রামের তিন পুরুষ চিকিৎসা-ব্যবসায়ী মশায়দের চিকিৎসালয়।  
--- “আরোগ্য-নিকেতন নামকরণ হয়েছিল পুরুষান্তরে জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলে জীবন মশায়ের আমলে তখন কালান্তর ঘটেছে একটি নতুন কাল শুরু হয়েছে দেশের কেন্দ্রস্থল নগরে নগরে তার অনেক আগে শুরু হলেও এ অঞ্চলে তখন তার প্রারম্ভ
একসময় “আরোগ্য-নিকেতন” লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকতো। গাড়ির সারি লেগে থাকতো। এখন সেসব কিছু নেই – একটি খণ্ডহরের মতো। কালান্তর ঘটেছে।

বিশেষ করে ১৮৩৫-এ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরীর পরে এদেশে হাসপাতাল-নির্ভর মেডিসিন (ঐতিহাসিক বিচারে যাকে hospital medicine বলা হয়), চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল এবং প্রত্যন্ত এলাকায় শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শিকড় পৌঁছে দেবার জন্য সাম্রাজ্যের মানবিক মুখ হিসেবে তৈরি করা চিকিৎসা্র হাত ধরে প্রচুর সংখ্যক দাতব্য চিকিৎসালয় বা ফ্রি ডিসপেনসারি তৈরী হতে থাকে।
উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখক এদুটির থেকে আরোগ্য-নিকেতনের পার্থক্য সূচিত করলেন। একটি ভিন্ন চরিত্রের চিকিৎসালয় – দাতব্য নয়, কিন্তু তেল-সিঁদূরের লালরঙে মোটা হরফে দেওয়ালে লেখা থাকে “লাভানাং শ্রেয় আরোগ্যম্”। চিকিৎসা-ব্যবসায়ী মশায়দের চিকিৎসালয়। অথচ জীবন মশায়ের ব্যবসার জন্য চিকিৎসার কোন নজির সমগ্র উপন্যাসে নেই – বিপরীতে রয়েছে আরোগ্যলাভই সংসারের শ্রেষ্ঠ লাভ। এরকম একটি মানসিক অবস্থান থেকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভের জন্য চিকিৎসা করা সম্ভব নয় – এটা পুনরায় বলার অপেক্ষা রাখেনাবরঞ্চ কাঞ্চনমূল্যের বদলে সাবেকি কৃষি-অর্থনীতির in kind ধরনে পুরনো কালের লোক পরাণ “খেতের ফসল, পুকুরের মাছ ডাক্তারের বাড়ি মধ্যে মধ্যে পাঠায়”কখনও নিজেই নিয়ে আসে।

In cash এবং in kind-এর টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায় উপন্যাসের একেবারে গোড়া থেকে। লক্ষ্য করার হল স্বাধীনতা-উত্তর রাঢ় বাংলার যে চিত্র তারাশঙ্কর এঁকেছেন সেখানে আধুনিক চিকিৎসার প্রতিনিধি হয়ে চিকিৎসক প্রদ্যোতের যে সত্তা আমরা দেখি তাঁর মাঝেও আজকের আগ্রাসী বাজার-র্নিমিত পণ্যমূল্যের আকাঙ্খা অনুপস্থিত। ওঁর কাছেও রোগীর আরোগ্যলাভই প্রধান প্রাপ্তি। মতির মা-র শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওঁর প্রত্যয় উচ্চারিত হয় –
“নাঃ, বেঁচে যাবে বুড়ি! মতি কিছু খরচ করতে প্রস্তুত আছে, বাকিটা হাসপাতাল থেকে ব্যবস্থা করে ওকে আমি খাড়া করে দেব। ওকে মরতে আমি দেব না।”

সময়টা আমরা স্মরণে রাখবো। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অভিঘাত যথেষ্ট শরীরীভাবে বিদ্যমান। সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক বহুলাংশে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক মননে কাজ করছে। এর অভিঘাতে প্রথম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে ১৯৫১ সালে। দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে হবে এটা নির্ধারণকারী অবস্থানে ছিল। আবার “মরতে আমি দেব না”-র মাঝে যে প্রত্যয় আছে সে প্রত্যয়ের হাত ধরে আসে দুটি বিষম জ্ঞানের জগতের সংঘাত। জীবন মশায় রোগীর নাড়ী পরীক্ষা করে নিদান হাঁকেন। (উপন্যাসে নিদানের ব্যবহার করা হয়েছে prognosis অর্থে, যদিও আয়ুর্বেদে নিদান বলতে প্যাথলজি বা etio-pathogenesis বোঝায়।)

ঘাড় নেড়ে মশায় জানান যে নিদান হেঁকে তাঁর বুড়িকে মরতে হবে না। বুড়ি নিজেই মরবে। মশায় বলেন – “তিন মাস কি ছ মাস – এর মধ্যেই ও মারা যাবে। ওর অনেক ব্যাধি পোষা আছে।”
এ রোগীর ব্যাপারে প্রদ্যোতের বক্তব্য – “পেনিসিলিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, এক্স-রে – এসবের যুগে ওভাবে নিদান হাঁকবেন না। ওগুলো ঠিক নয়। জড়ি বুড়ি সর্দি পিত্তি এসবের কাল থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি আমরা। এসব হল ইনহিউম্যান – অমানুষিক।” প্রসঙ্গত, এরকম এক মানসিক জগত থেকেই মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা প্রদ্যোত এল.এম.এফ চক্রধারীবাবুকে চিকিৎসক বলেই গণ্য করেনা, কারণ উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে লব্ধ জ্ঞান ছাড়া অন্য কোন ধরনের জ্ঞানের অস্তিত্ব এখানে অবান্তর। বিকল্প কোন জ্ঞানের অস্তিত্বকে অস্বীকার এবং আত্মসাৎ করে এগিয়ে রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতি অনুমোদিত জ্ঞানের বিজয় রথ।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন মান্য ঐতিহাসিক রয় পোর্টার অবশ্য মনে করেন – I do not think that “winners” should automatically be privileged by historians … but there is good reason for bringing winners to the foreground – not because they are the “best” or “right” but because they are powerful. (Roy Porter, The Greatest Benefit to Mankind, Harper Collins, 1997, pp. 1-2)অস্যার্থ, “বিজয়ীরা”-ই কেন সবসময়ে ইতিহাসবিদদের কাছে সুবিধেজনক অবস্থান পাবে? কিন্তু বিজয়ীরা সম্মুখে আসে তার কারণ এটা নয় যে এরা “সর্বোত্তম” বা “সঠিক”, বরঞ্চ এ কারণে যে তারা শক্তিমান।

আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয় একদিকে আয়ুর্বেদের ত্রি-দোষ তত্ত্ব, অন্যদিকে আধুনিক মেডিসিনের প্যাথলজি, ম্যাজিক বুলেট তথা অ্যান্টিবায়োটিক-নির্ভর চিকিৎসাপদ্ধতি – এদুয়ের মাঝে অনতিক্রম্য সংঘাত তৈরি হচ্ছে। উপন্যাসের স্তরে স্তরে ধরা পড়ে গ্রামের মানুষের একান্ত নিজস্ব মানুষ হিসেবে মশায়ের অবস্থান, তাঁর ওপরে হিন্দু-মুসলমান, জাত-বর্ণ নির্বিশেষে সবার নির্ভরতা, নাড়ী পরীক্ষায় তাঁর অভ্রান্ততা। আবার আধুনিক চিকিৎসা ও হাসপাতালের ওপরে ধীরে ধীরে অনিবার্য নির্ভরশীলতাও জন্ম নিচ্ছে। শুরু হচ্ছে দুটি জ্ঞানতত্ত্বের সংগ্রাম। শেষ অব্দি বিজয়ীর বেশে আসে উদীয়মান আধুনিক চিকিৎসাপ্রদ্যোত স্বাভাবিক নিয়মে বিজয়ীর অমোঘ বার্তা ঘোষণা করে – মশায়ের চিকিৎসা আনসায়েন্টিফিক

আনসায়েন্টিফিক, “অমানুষিক” কবিরাজী চিকিৎসা যা জীবন মশায়ের জীবন-সঞ্চিত একান্ত সততার ধন তা নিঃশব্দে স্থান ছেড়ে দেবে “হিউম্যান” তথা “সায়েন্টিফিক” আধুনিক মেডিসিনের কাছে। জীবন মশায় তাঁর সমস্ত কাল-সঞ্চিত জ্ঞান, প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য পিতৃত্বের মমতা, জীবনের একান্ত বান্ধব হয়ে মানুষের জীবনে লীন হয়ে থেকেও হেরে যাবেন।

উপন্যাসের একটি চরিত্র রাণা জীবন মশায়কে বলে – “তা ছাড়া মশায়, ডাক্তারদের কথা বড় চ্যাটাং চ্যাটাংবুঝেছেন – আমাদিগে যেন মানুষই মনে করে না। আপনারা রোগীর সঙ্গে আপনার লোকের মতো কথা বলতেন। ঘরের লোকের মতো” (নজরটান লেখকের)

এখানে আরো দু-একটি কথা বলে নিলে ভালো হয়। প্রথমটি হলো আয়ুর্বেদে দেহের ধারণা দ্বি-মাত্রিকদেহের মাঝে অনেকগুলো স্রোতবাহী নালী ইত্যাদি রয়েছে যেগুলো দিয়ে বায়ু, পিত্ত, কফের মতো বিভিন্ন রস প্রবাহিত হয় এরকম বিভিন্ন রসের ভারসাম্যের অভাব, প্রকৃতি বা macrocosm-এর সাথে বিষমতা কিংবা আগন্তুজ বা বহিরাগত কারণে (যার স্বরূপ নিরুপণ করা যায়না) রোগের উৎপত্তি। দেহের পরিসরে রোগের প্রকাশ ঘটলেও রোগের জন্ম বহুক্ষেত্রেই দেহাতিরিক্ত পরিসরে। একারণে এ শাস্ত্রে রোগের diagnosis-এর চাইতে অধিকতর গুরুত্ব পায় prognosis (রোগের ভবিতব্য)। আরোগ্য-নিকেতনের প্রায় ১০০ বছর আগে ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত মেডিক্যাল কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র সূর্য গুডিভ চক্রবর্তীর একটি পেপারে নীলমণি সেন নামে এক কবিরাজের উল্লেখ আছে তিনিও নিখুঁতভাবে prognosis বলে দিতে পারতেন।
এর বিপরীতে, আধুনিক চিকিৎসায় দেহের ধারণা ত্রি-মাত্রিক প্যাথলজিক্যাল অ্যানাটমি, শব-ব্যবচ্ছেদ এবং রোগের কোষ বা অঙ্গ-স্থানিকতা আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিকে পরম প্রত্যয়ী করে তুলেছে পুনশ্চ, নাড়ী পরীক্ষার বিষয়টি বৃহত্রয়ীর (চরক, সুশ্রুত এবং বৃদ্ধ বাগভট) যে প্রাচীন জ্ঞান-ভাণ্ডার তাতে কোন অধিক গুরুত্ব পায়নি। রুটিন পরীক্ষার একটি পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অধুনা আয়ুর্বেদের চলমান বিশ্বকোষ বলে স্বীকৃত মিউলেনবেল্ড মনে করেন – A new branch of Ayurveda suddenly appears in the thirteenth and fourteenth centuries. This branch, called Nadishastra, is concerned with with diagnostics and prognostication by means of the examination of the pulse … I feel Nadishastra did not become fully integrated with Ayurveda, since most treatises contain only few verses on the subject, while, on other hand, a separate class of monographs on pulse lore came into existence. (G. Jan Meulenbeld, “The Many Faces of Ayurveda”, Journal of the European Ayurvedic Society, 1995, 4, pp. 1-10)
এটা বোঝা কঠিন নয় যে রোগ নিরুপণের নির্দিষ্ট, সঠিক ও অভ্রান্ত কোন পদ্ধতি করায়ত্ত না থাকার জন্য পরবর্তীকালের আয়ুর্বেদজ্ঞরা (হয়তো বা ইউনানি পদ্ধতির প্রভাবে) নাড়ী পরীক্ষার দিকে বেশী বেশী করে ঝুঁকেছেন। নাড়ী পরীক্ষার সাথে অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাঢ় বঙ্গের, তন্ত্রসাধনাও যুক্ত হয়েছে। তারাশঙ্কর এ অঞ্চলের মানুষ। একদিকে মূল আয়ুর্বেদের নিদান ও আগন্তুজ রোগের ধারণা নিয়েছেন, অন্যদিকে পরিবর্তিত চেহারার নাড়ী-জ্ঞানকে করেছেন আয়ুর্বেদের প্রধান স্তম্ভ। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বড়ো কঠিন পরিস্থিতিতে আয়ুর্বেদের সাধকেরা তাঁদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়াসী হয়েছেনএদের সম্বল ভেষজ জ্ঞান (যে জ্ঞান উপনিবেশিক চিকিৎসা একসময় বহুল পরিমাণে আত্মস্থ করেছিল, পরে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির উদ্ভবের সাথে সাথে পূর্নতঃ প্রান্তিক করে দেয়)। মানুষী অস্তিত্বের প্রতি মমতা, যোগী ও শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে শেখা নাড়ী-জ্ঞান এবং অর্ধ-সমাপ্ত অ্যানাটমি তথা শবব্যবচ্ছেদ শিক্ষা – এই অদ্ভুত সমাহা্র নিয়ে জীবন মশায়ের চিকিৎসক অস্তিত্ব ও সত্তা

তারাশঙ্করের সংকট শুরু হয়েছে এ যাত্রাপথে। তিনি বাস্তব জীবনে জীবন মশায়কে দেখেছেন। তাঁর অসামান্য মানবিক অস্তিত্ব তাঁর স্মৃতিপটে বড়ো জীবন্তভাবে উৎকীর্ণ। আবার তাৎক্ষণিক বা স্বল্পকালে পরিস্ফুট রোগের ক্ষেত্রে (acute diseases) আধুনিক চিকিৎসার অসম্ভব শক্তি ও সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে পারছেন না, বরঞ্চ নিষ্কুন্ঠচিত্তে একে গ্রহণ করেছেন। মশায়ের চিন্তায় বিরাজ করে – “আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র বিপুল গতিবেগে এগিয়ে চলেছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র খুলে দিয়েছে দিব্যদৃষ্টি। রোগোৎপত্তির ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আজ সবই প্রায় আগন্তুজ ব্যাধির পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেল
এছাড়া তিনি অস্ত্রচিকিৎসার কথা শুনেছেন। শুনেছেন টিবি-র মতো রোগে স্ট্রেপ্টোমাইসিন ছাড়াও পি-এ-এস বলে একটা ওষুধ বেরিয়েছে। দুটোর ব্যবহারে নাকি আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়। রঙ্গলাল ডাক্তারের কথা মনে পড়ে তাঁর – “শুধু পালানোটাই চোখে পড়ছে তোমার; মানুষ তার সঙ্গে অবিরাম লড়াই করছে দেখছ না? পিছু হঠেই সে আসছে চিরকাল – কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে আসে নি। নতুন নতুন অস্ত্রকে উদ্ভাবন করেছে, আবিষ্কার করেছে। সে চেষ্টার তো বিরাম নাই তার। মৃত্যুকে রোধ করা যাবে না, মৃত্যু থাকবেই। কিন্তু রোগ নিবারণ করবে সে।”

জীবন মশায় – প্রদ্যোত ডাক্তার
এতক্ষণ অবধি চিকিৎসা নিয়ে যে আলোচনা হল তার বাইরে সামান্য একটা বিষয় যোগ করা যায়। উপন্যাসের বয়ানে – “নবগ্রামে চারটে ডাক্তার বসে ফ্যা-ফ্যা করছে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি ছিল – চার বিছানার হাসপাতাল – তারপর যুদ্ধের সময় দেশে ‘মন্বন্তর’ হলে দশ বিছানার হাসপাতাল হয়েছিল – এখন পঞ্চাশ বিছানার হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। একজন ছোট ডাক্তার ছিল – এখন দুজন ডাক্তার হয়েছে – নার্স এসেছে। সেখানে গিয়ে ‘এলাম’ বলে একটা বিছানায় শুয়ে পড়লেই হল। সময়ে খাওয়া – সময়ে ওষুধ – য-বার খুশি ডাকলেই ডাক্তার। কেবল জাত থাকবে না আর মান থাকবে না বলে যায় না

এবার আমরা এক ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম। ১৯৪৭-এ প্রকাশিত “ভোর কমিটির”-র রিপোর্টে বলা হচ্ছে তখন ভারতের “অ্যালোপ্যাথিক” ডাক্তারদের ৭৭% আছে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে, ২৩% আছে সরকারি চাকরিতে। এখন সংখ্যাটা উদ্বেগজনক। ১৩০ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ৯০ কোটি গ্রামীণ ও দরিদ্র জনতার জন্য রয়েছে ১০ লক্ষের কিছু বেশি ডাক্তার। যাহোক, ১৯৫৩-র ভারতে সদ্য আধুনিক হাসপাতালের বিস্তৃতি শুরু হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে competing systems – সেরকম অনেকগুলো competing systems রয়েছে মানুষের তাৎক্ষণিক অসুখের চাহিদা মেটানোর জন্য, যেমন আয়ুর্বেদ, ইউনানি, গ্রামীণ হাতুড়ে চিকিৎসক, লৌকিক বিশ্বাস নির্ভর বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি ইত্যাদি। আবার জাত-পাত-ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষুণ্ণতার ভয়ে মানুষ অনেক কম হাসপাতালমুখী হচ্ছে। ফলে “সময়ে খাওয়া – সময়ে ওষুধ – য-বার খুশি ডাকলেই ডাক্তার”-এর সংকট নেই। সেসময়ে গ্রামাঞ্চলে এরকম ডাক দেবার লোক তুলনায় যথেষ্ট কম।

আজকের পরিস্থিতিতে যখন ১০,১৮৯ জন মানুষের জন্য একজন ডাক্তার এবং ২০৪৬ জনের জন্য একটি সরকারি হাসপাতালের বেড তখন সমস্ত পরিস্থিতিটিই একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। জীবন মশায়ের মতো কয়েক দশক ধরে বয়ে চলা “বিশ্বাস”-এর বাতাবরণ পরিবর্তিত হয়ে যায় “বুঝে নেবো”-তে, রোগীকে চিহ্নিত করা হয় “consumer” হিসেবে তখন বুঝতে হবে অনেক গভীরে ঘুণ ধরেছে। অনেক গভীরে এবং অনেক দূরে তাকাতে হবে আমাদের।

আমরা আবার উপন্যাসে ফিরে আসি মশায় প্রথম জীবনে অ-সরকারি ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাস করে (সেসময় এধরনের বেশ কিছু মেডিক্যাল স্কুল সাময়িভাবে তৈরি হয়েছিল) অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। সে বাসনা অবশ্য পূর্ণ হয়নি জীবনের এক বিশেষ বাঁকে এসে। পরে রঙ্গলাল ডাক্তারের কাছে শিষ্য হিসেবে প্রশিক্ষিত হন আধুনিক চিকিৎসায়। দুটি ব্যাপার আমাদের কৌতূহলী করে। একদিকে রঙ্গলালের কাছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা, অন্যদিকে মশায়ের শেষ অবধি শিক্ষা শেষ করতে না পারা। শিক্ষক রঙ্গলালের জীবনে দুটি স্তর আছে – হিন্দু পরিবার থেকে মিশনারি স্কুলে গিয়ে প্রথমে সংস্কার-চ্যুতি ঘটে, পরে এই সংস্কার-চ্যুত মানুষটি, সাধারণ মানুষের ভাষায় “নাস্তিকবাদী পাথর”, ময়ুরাক্ষীর জলে ভেসে যাওয়া মরা টেনে নিয়ে ফালি ফালি করে চিরে দেখেন। এককথায় যাকে বলে প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত private dissection – যে ডিসেকশন আধুনিক চিকিৎসাকে সম্পূর্ণত এক নতুন ভূমির ওপরে প্রতিষ্ঠা করেছে। সেরকম সময়ে জ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠান বা ইন্সটিটিউশন গ্রাস করে ফেলেনি। এজন্য কিছু private dissection হয়তো চালু ছিল
আমরা স্মরণে রাখবো উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে নব্য-আয়ুর্বেদ বলে আয়ুর্বেদের যে নতুন আবির্ভাব ঘটে (বাংলায় যার পুরোধা পুরুষ ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ গণনাথ সেন) তার ভিত্তি প্রস্তর তৈরি করছিল অ্যানাটমির আধুনিক পাঠমশায়কে শিক্ষা দিতে গিয়ে রঙ্গলাল একবার বলেছিলেন – “তা ছাড়া আগন্তুজ ব্যাধি বলে যেখানে থেমেছে, ইউরোপের চিকিৎসা-বিদ্যা মাইক্রোস্কোপের কল্যাণে জীবাণু আবিষ্কার করে অনুমান ও উপসর্গের সীমানা ছাড়িয়ে চলে এসেছে বহুদূর এগিয়ে।” উপন্যাসের প্লট অনুযায়ী, এর কিছুদিন পরে, সম্ভবত নাড়ী বিশেষজ্ঞ কবিরাজ হয়ে ওঠার ভবিতব্য নিয়ে, জীবন মশায় ডিসেকশনের পরীক্ষায় ফেল করেন। যতটা নিস্পৃহ হলে ডিসেকশন করা সম্ভব (উইলিয়াম হান্টারের বিখ্যাত উক্তি “necessary inhumanity” বা “clinical detachment” বলে যা আধুনিক মেডিসিনে সমধিক পরিচিত) ততটা তাঁর করায়ত্ত হয়নি।
রঙ্গলাল জীবনকে বলেছিলেন – “তোমার ডাক্তারি শেখাটা বোধ হয় ঠিক হল না জীবন। তোমার সে বৈজ্ঞানিক মন নয়। কার্য হলেই তোমার মন খুশী। কেন হল – সে অনুসন্ধিৎসা তোমার মনে নাই। তুমি বরং ডাক্তারি, কবিরাজি, মুষ্টিযোগ তিনটে নিয়েই তোমার ট্রাইসিকেল তৈরী কর। ওতে চড়েই যাত্রা শুরু কর।”
আমাদের মনে পড়ে ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত রিচার্ড হ্যাভেলক চার্লসের কথা (তৎকালীন লাহোর মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির সুখ্যাত শিক্ষক ও পরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছিলেন) – The education of the Indian has in the past been purely an intellectual training, and consequently he is defective in scientific observation and curiosity, being marked more for his powers of subtle speculation and poetic fancy, whilst lacking that exactness of learning given by the laborious investigation of facts. (নজরটান লেখকের)

রঙ্গলালের সাথে কি অদ্ভুত মিল হ্যাভেলক চার্লসের! ভারতীয় এবং ইউরোপীয় ধারার জ্ঞানতত্ত্ব ও শিক্ষণের মাঝে মৌলিক ও সুস্পষ্ট ভেদরেখা স্বতঃপ্রকাশিত। আবার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের এই empirics-কে ভয় করে আধুনিক চিকিৎসক প্রদ্যোত বা আধুনিক চিকিৎসা। ভয় পায় বলেই এড়িয়ে চলতে চায়, অপ্রয়োজনে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়। জ্ঞানের জগতে নিটোল আত্মপ্রত্যয়ী হয়েও অজ্ঞাত, ধূসর জ্ঞানাঞ্চলের empirics-কে প্রতিষ্ঠাকামী, আধিপত্যকারী চিকিৎসা ভয় পায়। প্রদ্যোতের মুখের কথায় – “কয়েকটা কেসেই আমি আপনাকে হাত দেখতে দিই নি। আমার ভয় হত, আপনি কী পাবেন – কী বলে দেবেন। আপনার হাত দেখাকে আমার সময় সময় ভয় লাগে।”
প্রদ্যোতের সাথে কথোপকথনে জীবনের আরেকটি গভীরতর সত্য উচ্চারণ করেন মশায়। মৃত্যুকে প্রতিটি দেশ, অঞ্চল, জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি নিজের নিজের মতো করে দেখে এসেছে। মৃত্যুকে নিজেদের মতো করে বরণ করে নিয়েছে। তিনি তাঁর দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে একদিকে যেমন জীর্ণ পরিণতির ক্ষেত্রে মৃত্যু নিদান হেঁকেছেন, আবার অন্যদিকে যে প্রবীণ, যে বৃদ্ধ বয়সেও বহুজনের আশ্রয়, বহুজনের কর্মী তাকে বাঁচাতে মরণের সাথে লড়াই করেছেন। এরকম কোন চালচিত্র তৈরি হয়নি তখনো যে অসুস্থতা মানেই গৃহের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে হাসপাতালের পরিবেশে যাত্রা শুরু হবে। আর শেষ হবে আরও অনেক রোগীর মাঝে রোগের পরিসরে। রোগীর জীবনের বাস্তবতা, আত্মা হারিয়ে যাবে হাসপাতালের সম্পূর্ণ অনাত্মীয় পরিবেশে। মৃত্যু সম্পর্কে এসব ধারণা তখন ক্রম-স্ফুটমান। এখানে মনে পড়ে যায় এ যুগের অতি-আলোচিত এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী দার্শনিক ইভান ইলিচের কথা – The white man’s image of death has spread with medical civilization and has been a major force in cultural colonization. (Ivan Illich, Medical Nemesis: Limits to Medicine, Penguin, 1978, p. 180)

চিকিৎসা-মৃত্যু-জীবন মশায়
সেসময়ের বাংলার সময়-বাহিত, অভিজ্ঞতা-সিঞ্চিত পরিবেশে যৌবন-বার্ধক্য-জরা-মৃত্যু-কে জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখার মানসিক স্থৈর্য একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের মাঝে বিরাজ করতো। বহুক্ষেত্রেই চিকিৎসার ভয়াবহতার চেয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু বেশি কাম্য ছিল। এমন কি রোগীর মৃত্যু অবধারিত জেনেও জীবন মশায় বারংবার পরমানন্দের শরণ নেন। “জীবন আর মৃত্যু? যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যু – তিনিই আনন্দস্বরূপ।”
নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি এ বিশ্বাসে স্থিত থাকেন। তাঁর হৃৎপিণ্ডে তিনবার সংক্রমণ হয়েছিল। দ্বিতীয় আক্রমণের আগের দিন নিজেই মৃত্যুর শরীরী রূপ বর্ণনা করেছিলেন প্রদ্যোতের কাছে – “ডাক্তারবাবু, এইবার সে বকুলতলা থেকে বিশ্রাম সেরে উঠে দাঁড়াল।”
প্রদ্যোতের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি কথাটা। কারণ রক্তচাপ সেই একইরকম ছিল। এরপরে রক্তচাপ বাস্তবিকই বেড়েছিল। সন্ধ্যেতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেনএর কদিন পরে হয়েছিল তৃতীয় আক্রমণ। প্রদ্যোত ডাক্তারকে তিনি বলেছিলেন – “আমাকে ঘুমের ওষুধ দেবেন না। ঘুমের মধ্যে আমি মরতে চাই না। আমি সজ্ঞানে যেতে চাই।”

শান্তভাবে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছিলেন। তিনি জানতেন সে আসছে। তার পায়ের ধ্বনি তিনি শুনতে পেয়েছেন। প্রদ্যোত দেখলো – “প্রগাঢ় একটি শান্তির ছায়া শীর্ণ মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে।”
জীবন মশায় চলে গেলেন। তার আগে প্রদ্যোতের সাথে তাঁর সখ্য তৈরি হয়েছেচিকিৎসার জ্ঞানের নতুন সম্ভারকে তিনি শান্ত মনে গ্রহণ করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন। প্রদ্যো্ত তখনো বাজার-নিয়ন্ত্রিত একজন স্বাস্থ্য “পরিষেবক” হয়ে ওঠে নি। তখনো সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের সামাজিক আবহে লালিত মানবসেবা নামের আদর্শবাদ তাঁর চোখে লেগে রয়েছে। তখনো নিউইয়র্ক আর নৈহাটি একাকার হয়ে যায় নি। যদি যেত তাহলে তাহলে সে জীবন মশায়ের মৃত্যুশয্যায় তাঁর সঙ্গী হয়ে থাকতো না। কারণ, কবিরাজি বা নাড়ীর জ্ঞান সে সময়ে নিতান্ত প্রান্তিক একটি বিষয় হয়ে উঠছে।

উপন্যাসের বুনটে আমরা আধুনিক মেডিসিনের প্রশ্নাতীত ঔৎকর্ষ বরণ করে নেবার অমোঘ ইঙ্গিত দেখতে পাই – “কিন্তু জীবন মশায় সেদিন মনে মনে মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের সাধনাকেও প্রণাম জানিয়েছিলেন। মৃত্যুকে জয় করা যাবে না, কিন্তু মানুষ অকালমৃত্যুকে জয় করবে। নিশ্চয় করবে। ধন্য আবিষ্কার! ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের প্রণাম করেছিলেন। হ্যাঁ – আজ বেদজ্ঞ তোমরাই।”

কেবলমাত্র রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসম্পূর্ণতা, অপ্রতুলতা এবং বন্টন ব্যবস্থার অপদার্থতার জন্য ১৩০ কোটি মানুষের দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার উপকরণগুলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয় বলে অধুনা AYUSH-এর মাঝে “নব্য-আয়ুর্বেদ”-কে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। নতুন মেডিক্যাল কাউন্সিল বিলে প্রশিক্ষিত “অ্যালোপ্যাথিক” ডাক্তার এবং নব্য-আয়ুর্বেদের উপজাত চিকিৎসক একাকার হয়ে যাচ্ছে সরকারি পরিষেবার জগতে৯০,৩৪৩ জন ভারতবাসীর জন্য একটি সরকারি হাসপাতাল বরাদ্দ। প্রাইভেট সেক্টর বহির্বিভাগের রোগীর প্রায় ৮০% এবং ভর্তি-হওয়া রোগীর ৬০% নিয়ন্ত্রণ করে। পাঁচ-তারা সাত-তারা সাজে সেজে ওঠে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক। আর খিদের জ্বালায় আত্মহত্যা করা বিশাল ভারতভুখণ্ডের জন্য বরাদ্দ AYUSHএখানে “অ্যালোপ্যাথিক” ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে ভুল চিকিৎসা কিংবা রোগী মৃত্যুর জন্য জবাবদিহি করতে হয়না।

এদেশে চিকিৎসার খরচ মেটাতে ঘটিবাটি বিক্রী করে, সহায়-সম্বল খুইয়ে প্রতিবছর প্রায় ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান ৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। একটি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হয় “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ (medical poverty trap)” ১৯৭৮-এর আলমা-আটা সম্মেলনে গৃহীত শ্লোগান ছিল “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”। জোর দেওয়া হয়েছিল “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের যত্ন” বা “comprehensive primary health care”-এর ওপরে। জীবন মশায় বা প্রদ্যোত ব্যক্তি রোগীর স্বাস্থ্যের চিকিৎসা করেও জনতার স্বাস্থ্যকে ধরেছিলেন। আজ সেই স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্যের বোধ রূপান্তরিত হচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবা-র বোধে। ৯০ কোটি গ্রামীণ এবং দরিদ্র শহুরে জনতার জন্য AYUSH এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা যারা কিনতে পারবে তাদের জন্য ঝাঁ-চকচকে পাঁচ-তারা সাত-তারা কর্পোরেট হাসপাতাল।
রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক পুঁজির আগ্রাসী জগৎ এবং স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছে, বিভিন্ন ধরন-ধারণকে। ইউরোপে এ বিষয়টি আমাদের অনেক আগে ঘটেছে। এর অভিঘাতে আরেক যুগন্ধর সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল – You see, gentlemen, reason is a good thing, that can’t be disputed, but the reason is the only reason and satisfies only man’s intellectual faculties, while volition is a manifestation of the whole of life … life frequently turns out to be rubbishy, all the same it is life and not merely the extraction of a square root. (Dostoyevsky, Notes from the Underground, Penguin, London, 1972)

জীবন মশায়ের কর্মপ্রবাহের আরো অনেক আগে ১৮৩৫ সালে যেদিন কলকাতায় এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজ তৈরী হল সেদিন মৃত্যু ঘন্টা বেজেছিলো ভারতে ব্রিটিশদের তৈরী প্রথম মেডিক্যাল স্কুল নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশনের – যেখানে ইংরেজী, নাগরী এবং আরবী তিনটি ভাষাতে শিক্ষা দেওয়া হতো। একটি বহুত্ববাদী শিক্ষার প্রচলন হয়েছিলো, যদিও ব্রিটিশদের নিজেদের স্বার্থেই। এক দশকের বেশী সময় জুড়ে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দখল নেবার জন্য সামরিক প্রয়োজন মেটাতে নেটিভ ডাক্তারদের দরকার পড়েছিলো। মেডিক্যাল কলেজ তৈরীর ঘোষণার পরে যখন এর প্রয়োজন ফুরলো সেদিন এদেরকে প্রায় কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছিলো – বাণিজ্যিক পুঁজি থেকে শিল্পীয় পুঁজিতে আংশিক রূপান্তরের সে ঐতিহাসিক মুহূর্তে পুঁজি ও রাষ্ট্রের নিজের নিয়মে। সীমা আলাভির বর্ণনায় – As the students of NMI (Native Medical Institution, (১৮২২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক পাঠ দেবার জন্য ভারতে ব্রিটিশদের তৈরী প্রথম মেডিক্যাল স্কুল) and its staffers dispersed into the qasbas and towns of the North Indian countryside, so did their new ideas and texts. (Seema Alavi, Islam and Healing, permanent black, 1996, p. 98) পুঁজির প্রয়োজনে পরিত্যক্ত এ বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিলো জনতার মাঝে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে এদের উত্তরাধিকারীরা, সন্ততিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। এটা আরেক ঐতিহাসিক সত্যি। অন্য পরিসরে আলোচনার বিষয়।
জীবন মশায় যখন তাঁর চিকিৎসার বিশিষ্টতায়, মানুষের মাঝে লগ্ন হয়ে থাকার অভীপ্সায় আধুনিক চিকিৎসার প্রতিস্পর্ধী হয়ে নিজের অস্তিত্বের বিশিষ্ট অর্থ বহন করছেন সেসময় তিনি বড়ো একক নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। চারপাশের মানুষেরা তখন বড়ো বড়ো রাস্তা, বিজলী বাতির উন্নয়নের রোশনাই-এর কাহিনী শুনতে চায়। নিজেরা আধুনিকতার এ পরশ নিয়ে জীবন যাপণ করে। অদ্ভুতভাবে প্রায় সমসময়ে এরকম আরেকটি একক নিঃসঙ্গ চরিত্র সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই। জীবনের শেষ পর্বে এসে ঢোঁড়াই চওড়া রাস্তায় এসে দাঁড়ায় – সবদিকে বড়ো বড়ো গাড়ি হুস হুস করে চলে যাচ্ছে। এ কেমনতরো ভারত? একে সে চেনেনা। ওর প্রাণের সাথে, ওর গ্রামীন জীবনের সাথে কোন সংযোগ খুঁজে পায়নাওর সত্তার থেকে পৃথক হয়ে যায় এ নতুন ভারতবর্ষ। জীবন মশায়ও পাননি তাঁর আজন্ম লালিত, যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা চিকিৎসার দুনিয়ায়। আধুনিক ভারতের আকাঙ্ক্ষা এবং ইউরোপের সমকক্ষ হয়ে ওঠার জন্য নতুন আধুনিকতার প্রবক্তা দেশনায়কদের প্রবল আকুতি, মতাদর্শ ও লিপ্সার চিহ্ন তীক্ষ্ণভাবে বহন করছে ই টি আব্রাহামের The Making of the Indian Atomic Bomb এবং হোমি ভাভার The Location of Culture বইদুটি। বইদুটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কিভাবে আধুনিক ভারত গড়ে ওঠার পরতে পরতে রয়েছে যাকিছু তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক” – সে শিক্ষাক্রম হোক বা প্রযুক্তি – তাকে যেকোন মূল্যে গ্রহণ করে ইউরোপ আমেরিকার সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে। এবং এ প্রক্রিয়ার অনিবার্য derivative হিসেবে নাকচ করতে হবে এত প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বা experiential knowledge. দেশের বিভিন্নতাকে সমসত্ত্ব ও সমান করে দিয়ে আধুনিকতার প্রকাশ চিহ্নগুলো সংস্কৃতির প্রতিটি প্রকাশে এঁকে দিতে হবে। প্রাচীন জ্ঞান থাকবে antique প্রদর্শনী হিসেবে।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সময় ও ঐতিহ্য-লালিত অভিজ্ঞতা, মৃত্যু জীবন ও বেঁচে থাকা, মানুষের জীবন স্পন্দনের মাঝে স্থিত চিকিৎসক, শেকড়হীন হাসপাতাল ইত্যাদি অপরিমেয় প্রসঙ্গের একটি চলমান আলেখ্য আরোগ্য-নিকেতন যা চিকিৎসা-ব্যবসায়ের অভিমুখে হলেও ব্যবসা করে না। জীবনের আরেকটি মাত্রা এবং ভিন্নতর অর্থ বহন করে। জীবন মশায় মতির মা-কে বাধা দিয়ে বলেন – না। আমাকে দেখালেই বাঁচত কে বললে? সংসারে ডাক্তার-বৈদ্যতে রোগ সারাতে পারে, মৃত্যুরোগ সারাতে পারে না বাবা।

উপন্যাসের আরেক অংশে আমরা দেখি এক সম্মিলন কিংবা দুটি জ্ঞান্তত্ত্বের একটি ছেদবিন্দুনতুন জ্ঞানকে জায়গা করে দিচ্ছে ঐতিহ্যলালিত, জীবনাশ্রয়ী পুরনো জ্ঞান। নতজানু চিত্তে মেনে নিচ্ছে, কান পেতে শুনছে অমোঘ, অনতিক্রম্য নতুন ও আধুনিক চিকিৎসার বৈতালিক।
“রাত্রি তখন দুটো। মশায় ডাকলেন – ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!
প্রদ্যোত উঠে এল – কে?
__ আমি জীবন দত্ত।
__ আপনি এত রাত্রে?
__ বিষ খেয়েছে একটি মেয়ে! কল্কেফুলের বীজ। তাকে নিয়ে এসেছি। পরান খাঁয়ের স্ত্রী।
__ আমি আসছি এক্ষুনি। ওদিকে কম্পাউন্ডার নার্সরা উঠেছে? তাদের ডেকেছেন?
__ ডেকেছি।
__ এক মিনিট। আসছি আমি।
ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা হাফশার্ট গায়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এল। কোন প্রশ্ন করলে না, কোন মন্তব্য করলে না।
……………..
ডাক্তার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, পরান বললে – আমি চললাম ডাক্তারবাবু, মেয়েটা বাঁচলে পর পুলিসে দিবেন, না বাঁচে লাশ সদরে চালান দিবেন; সেখানে ফেড়েফুড়ে দেখে যা করার করবে। সালাম!
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার বললে – আঃ তখুনি যদি আপনার কথায় গোসা না করতাম! আপনাকেই যদি দেখাইতাম! মশায় বুড়ো লোক, সিকালের লোক, নাড়ী দেখে মরণ ডাকতে পারে। ই ধরতে পারে না। চলে গেল পরান।”
মৃত্যুর প্রশ্নে আধুনিক চিকিৎসা নীরব হয়ে যায়, হয়ে পড়ে নৈর্ব্যক্তিক। একজন পূর্ণ মানুষ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সংখ্যায় পরিণত হয়। মৃত্যু মানে একটি বেড খালি হয়ে যাওয়া, হয়তো তার কেস নম্বরের সংখ্যায় চিহ্নটি হল ৬৭। কিন্তু মানুষটির পরিজনের কাছে সে স্মৃতির উত্তরাধিকার, suffering বা ক্লিষ্টতার মূর্তরূপ। এই suffering বা ক্লিষ্টতাকে আধুনিক মেডিসিন এখনো অবধি তার জ্ঞান কাঠামোর মাঝে ধারণ করতে পারেনি। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনাও দার্শনিক মহলে চলছে। এ বিষয়ে অন্যতম অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বরা হলেন আর্থার ক্লিনম্যান, মার্গারেট লক বা ভারতের বীণা দাশ। এর পরিণতি? আর্থার ক্লিনম্যান খুব স্পষ্ট করে জানান – The result is a huge split between the constructed of biomedical cure – the dehumanized disease process – and the constructed object of most other healing systems – the all-too-humanly narrated pathos and pain and perplexity of the experience of suffering. (Arhtur Kleinman, “What is Specific to Western Mediicne?” in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, vol. 1, pp. 15-23)
অস্যার্থ, আধুনিক মেডিসিন বা বায়োমেডিসিন রোগীর অস্তিত্ব থেকে রোগ প্রক্রিয়া পৃথক করে ফেলে চিকিৎসার নির্মাণ করে। চিকিৎসার লক্ষ্যমুখ বা কেন্দ্রে থাকে রোগ, রোগীর ব্যক্তি অস্তিত্বের বিশিষ্টতা নয়। ফলে রোগকে বোঝার এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া হিসেবে যা চালু হয় তা একটি “dehumanized” বা অমানবিক প্রক্রিয়াএখানে বাতিল হয়ে যায় একান্ত মানুষী অনুভব থেকে বিবৃত “pathos and pain”, উপেক্ষিত হয় suffering তথা ক্লিষ্টতার অভিজ্ঞতার মাঝে বিমূঢ় করে দেবার যে অভিজ্ঞতা আছে সে অভিজ্ঞতা

মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন জীবন মশায়“সে আছে তিনি জানেন। তার পায়ের ধ্বনি যেন তিনি শুনতে পেয়েছেন। “….. তিনি দেখবেন; তার স্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর শুনবেন; তার গন্ধ থাকলে নিশ্বাসে গ্রহণ করবেন; তার স্পর্শ থাকলে সে স্পর্শ তিনি অনুভব করবেন
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, তাঁর শেষ মূহুর্তের সাথী প্রদ্যোত ডাক্তার এবং তাঁর স্ত্রী আতর-বউ। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময় ... মশায় কি দেখলেন প্রদ্যোত বুঝতে পারলে না ... জীবন মশায়-এর স্ত্রী শান্ত সমর্পণের মতো স্বামীর বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝে সামাজিকভাবে স্থিত এক যোগসূত্র তৈরী হলো – আধুনিক চিকিৎসার বোধগম্যতার বাইরে।
প্রদ্যোতের কি সে মুহূর্তে কোনভাবে মনে পড়ছিল এলিয়টের এই কথাগুলো?
One thing you cannot know:
The sudden extinction of every alternative,
The unexpected crash of the iron cataract.
You do not know what hope is, until you have lost it.
You only know what it is not to hope:
You do not know what it is to have hope taken from you. (The Family Reunion)

উত্তর মেলেনা!






No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্...

পাঠকের পছন্দ