(বকবকিং গদ্যগুলির গুরু মুজতবা আলী,
অর্থাৎ হার্ডকোর মজলিশি গদ্য, ডাইগ্রেসান যার প্রাণধর্ম। আড্ডার মূলসুত্র অর্থাৎ
প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার অন্দাজকে ব্যবহার করা আছে এতে। তবে ফুল
গ্যাঁজানোর আড্ডা নয়, সাথে আছে কিছু বিশেষ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা, চরম রিডেবিলিটির
মোড়কে। যেমন এতে প্যারালেক ভাষা, ল্যাটারেল থিংকিং নিয়ে কথা। কিছু টাইপো বানান ভুল
থাকতে পারে, অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিলাম তার জন্য আবহমানের পাঠকদের কাছে।)
একেক সময় আসে যখন সময় যে একটা বিশেষ
ধরনের অতিকায় প্রাণী, এ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকেনা। ধরো একটা ঘর, তুমি লেখ, ঘরে তুমি
আছ (প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো যে আমি লেখক ভিন্ন অন্য কোন ধরনের মানুষে বিশ্বাস
করিনা। লেখে সব্বাই, ফারাকটা হলো, কেউ লেখে শব্দ দিয়ে,তো কেউ লেখে ঘরকন্না দিয়ে,
কেউ লেখে একলা দিয়ে, কেউ লেখে দশটা পাঁচটা দিয়ে), তো ফিরে যাই, একটা ঘর, তুমি
লেখো, ঘরে তুমি আছো, সময়টা পুঁথিগত বিদ্যে দিয়ে বললেদুপুর। তার বাইরে গেলে, বাহির
একটা নানারকম ভাপ দিয়ে তৈরী অট্টালিকা, সেই অট্টালিকার ঠিক বাইরেই তোমার ঘর,
যেখানে তুমি আছো, নানাধরনের, নানাগড়নের ভাবনাচিন্তা খাটের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটি
একাকার হয়ে তুমি বসে আছো, বাহির নামক অগাধকেল্লাটার ইটপাথর যে ভাপ, সে তোমার বুকে
পিঠে ঠোক্কর মারছে কারন তোমার দরজা জানলাখোলা। বাস, ট্যাক্সির আওয়াজগুলো সকলেই
"দূ-ঊ-ঊ-র" শব্দ করে মিলিয়েযাচ্ছে... যা তোমার কানে আসছে তা হলো
নানারকমের চলন্ত দীর্ঘ-ঊ... আর শুনতে পাচ্ছযে ফেরিওয়ালা হাঁটতে হাঁটতে একটা ছায়ায়
এসে থামলো ঝিমিয়ে নিতে, তার ঝিমিয়ে নেওয়ারআওয়াজ। তুমি দরজা, জানালার দিক থেকে মুখ
ফিরিয়ে নিয়ে, মানে সেদিক পিঠ করে বসে আছো,চাই কি পর্দাগুলোকেও নামিয়ে দিয়েছ কাজে,
কিন্তু কেমন যেন বুঝতে পারছো বাইরে ঝপাসকরে আকাশের মতো গামলার এক গামলা হলুদ কেউ
যেন উলটে দিয়েছে। সেই হলুদের ছিটে আরফোঁটা দুইজন তোমার গায়েও এসেছে। এমন সময় তুমি
ভাবতে গেলে এটা কি সময় আর সঙ্গেসঙ্গে টের পেলে, ওই ভাপের তৈরি বাহির নামক কেল্লা,
উপুড় হলুদ, দীর্ঘ-ঊ শব্দ করাগাড়ী, ফেরিওয়ালায় মর্চে পড়ার মতো ফেরিওয়ালার ঝিমুনি,
তোমারই ছুটকো ছাটকা দু একটাভাবনা চিন্তা যেগুলো পাকামি মেরে বাইরে গেছে এবং তোমার
গায়ের ওপর একটা সর্বাঙ্গগন্ধী ছোঁয়া, এই সমস্ত একটা ব্র্যাকেটের মধ্যে চলে এল। আর
সেই ব্র্যাকেটটা যেন পুরোনো কি লজ্জার কথা মনে পড়েছে এই ভেবে শিউরে উঠে
ত্যাড়াবাঁকা হয়ে সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে থেকে গেল। আর তুমি বুঝতে পারলে সময় একটা
প্রকান্ড কচ্ছপের মতো নড়েউঠলো।
ব্যাস,এতক্ষনে একটু শান্তি এলো।
এতক্ষন কি করছিলাম বলুন তো? কোন সাহিত্য ফাহিত্য নয়, একা যে তিরিক্ষে আবহাওয়ার
মধ্যে বসে লিখছিলেম তার মধ্যে পাঠকবাবুকেও এনে ফেললেম। আমিএই ভর দুপুরে
রোদ্দুরাক্ত হয়ে লিখবো আর আপনি সেটি রাত্তিরে ঠান্ডা ঘরে বসে কুলকুল করে পড়বেন, এই
ইয়ার্কি নেহি চলেগা। ভাবা যায় বকবকের পঞ্চম খন্ড অবধি চলে এসেছে!!!এখনো লোকে
পড়ছে!!!! পড়া বলতে মনে পড়লো, এই মুহূর্তে আমার হাতে আছে পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ জগতের
ওপরে করা একটা রিসার্চ পেপার। ভক্তিপ্রসাদ মল্লিকের করা এই রিসার্চটি বাংলার অপরাধ
জগতের ভাষা ও শব্দ নিয়ে একটি অতুলনীয় কাজ। এখানে মল্লিক মশাই শুধুমাত্র অপরাধ
জগতের শব্দাবলী জোগাড় করে ক্ষান্ত হননি, চলে গেছেন একেবারে গোড়ায়,বুৎপত্তি অবধি।
ফলে বেরিয়ে এসেছে অসাধারণ কিছু তথ্য। যেমন ইঙ্গিত ভাষা।
করতলদেখানো- তালাভাঙার যন্ত্র চাওয়া
হাত দুখানাদেহের পেছনে- চুরির বা
তালাভাঙার জায়গা আড়াল করার কাপড় চাই
করতল কপাল থেকে মাথার পেছন অবধি ঘষা-
মানে অল ক্লিয়ার, বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়া যায়
মাথার পেছনথেকে সামনের দিকে আনা- কেউ
নজর রাখছে বা পুলিশ আছে কাছাকাছি
বিড়ি বারকরা- কাজ শেষের দিকে, বাইরে
যারা আছে তারা যেন ট্যাক্সি ধরে
ফাউন্টেনপেন দেখানো- চাবি চাই
ফাউন্টেনপেন দুই অংশ দেখানো- তালা
চাবি দুই চাই
এ্যাদ্দুর এসে আমি খুব চিন্তামগ্ন হয়ে
পড়লেম, গব্বাবাজ বা চোরের চাবি প্রয়োজন বুঝতে পারলেম কিন্তু তালা কেন প্রয়োজন তা
ভেবে বার করতে পারছিলেম না। হদিশ পেলাম ইদানীংকালেরকুসংস্কারের ওপর করা একটি
রিসার্চ পেপারে। চোর বা গব্বাবাজ কোন বাড়িতে চুরি করলেসেখানে কোথাও না কোথাও একটা
নতুন তালা লাগিয়ে যাবে। এটা একটা সংস্কার, এটার অর্থপুলিশি তদন্তে ধরা পড়ার
সম্ভাবনা কম। এতটাই গভীর এই সংস্কার যে কোন অপারেশনে তালালাগানোর সময় না পাওয়া
গেলে সর্দার খুবই টেনশানে থাকেন। যাকগে, এতো হলো চোর বাগব্বাবাজের ইঙ্গিত ভাষা।
পকেটমারের ইঙ্গিত ভাষার বহর শুনুন, কাজে দেবে পথেঘাটেসজাগ থাকতে।
পকেটমার যখন হাত দিয়ে যেদিকের কাঁধে
চাপ দেবে তার অর্থ সঙ্গীকে বলা সেদিকের ব্যক্তির পকেটেমালকড়ি আছে। যেদিকের ভ্রু
নাচাবে, সঙ্গী বুঝবে সেদিকের পকেটে টাকা আছে। ধুর অর্থাৎ টার্গেটকে বোকা বুঝতে
পারলে ঘন ঘন তুড়ি দেবে। কাজ শেষ, নেমে পড়ার সময় এসে গেছে,তখন সশব্দে হাই তুলবে
ঘনঘন। ঘনঘন কাশির অর্থ বিপদ আছে। ডান হাত তুলে কন্ডাক্টরকে ডাকা অর্থাৎ কাজ সফল
ভাবে শেষ।
তবে এই ভাষা শুধুমাত্র কলকাতার
পকেটমার জগতে প্রচলিত। দিল্লিতে বাসের মধ্যে হাই তোলা লোককে পাকড়াও করলে বিস্তর
অসুবিধের সম্মুখীন হতে হবে। পকেটমার জগতে চালু কিছু শব্দের নমুনা দেখে খুব আমোদ
হয়েছিল। হোস-পাইপ মানে প্রেমের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি,লালবাতি মানে বিবাহিতা,
প্রিন্টেড মানে মহিলার পশ্চাদ্দেশ, চাঁদনি মানে ঝানুমহিলা, ভয়েসচেঞ্জ মানে
সাকরেদগিরি থেকে সর্দারের স্তরে ওঠা। এর ব্যুৎপত্তি কিশোর বয়সে গলা পরিবর্ত্তন
থেকে আগত। অদ্ভুত না?? যেন একটা প্যারালেল সমাজব্যবস্থা,প্যারালেল ভাষা নিয়ে বয়ে
চলেছে শহরে আমরা তার হদিসই জানিনা। এই স্ল্যাং উৎপত্তি নিয়ে একটা মজাদার গল্প আছে।
একবার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে একজন কয়েদীর কাছে গাঁজা পাচার করা হয়েছিল সেদিনের খবর
কাগজের ভাঁজে ভরে। সেদিনের হেডলাইন ছিল দলাই লামা তিব্বত থেকে ভারতে এসে আশ্রয়
নিয়েছেন। সেখান থেকে গাঁজার একটা কোড নেম হয়ে গেল দলাই লামা। সোমনাথ থুড়ি মানবী
বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অনবদ্য বই ছিল কলকাতার হিজড়েদের প্রথা ও ভাষা নিয়ে,
"অবহেলিত, বঞ্চিত, প্রোষিতভতৃকা"। বইটিকে বহুদিন হয়ে গেল দেখতে পাই না।
ওতে পড়েছিলাম হিজড়েদের ভাষা কিরকমভাবে সভ্য সমাজের প্রতি প্রতিবাদস্বরূপ সভ্য
সমাজের ভাষা থেকে সম্পূর্ন আলাদা। ওই কীতাবটি পড়ে আমার প্রচন্ড কৌতূহলে পায় এই
গোষ্ঠিটির প্রতি। আমি নিজেই নামি রিসার্চে এবং প্রায় দেড়বছরব্যাপী একটানা গবেষনায়
যা যা জানতে পারি তা বিস্ময়ের একশোগুন করে যদি কোন নতুন অনুভূতির জন্ম হয়, তার
তুল্য। ওদের জীবনযাপন যৌথ, সেই থাকার জায়গাটিকে ওরা বলে খোল। সেখানেই অবাক করা
তথ্য পেয়েছিলাম যে সভ্য সমাজে জীবন যাপন করা অনেকপুরুষই একসাথে একটি দ্বিতীয়
সত্ত্বা, হিজড়ে সত্ত্বা বজায় রেখে চলে। হিজড়ে সমাজকঠোরভাবে মাতৃতান্ত্রিক। চাইলেই
কেউ হিজড়ে হতে পারেনা। ওদের একজন গুরুমা থাকেন।তাঁর আন্ডারে থেকে অনেক আচার, রীতি,
প্রথা পালন করতে হয়, তারপর দীক্ষাদান হয়। হিজড়েরা বস্তুত শুধুই পুরুষ, মহিলা হিজড়ে
কাঁঠালের আমসত্ত্ব। আমার অফিস ছিল সেসময়পাম এভিনিউ। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির
একদম উল্টোদিকে। সেখানেই কাছাকাছি একটি খোল ছিল। বাই দ্য ওয়ে, খোল বলতে কেউ যেন
বস্তি না ভেবে বসেন। রীতিমতো সো কল্ডসভ্য বসতির মধ্যেই থাকে খোল, একসাথে কয়েকটি
বাড়ি নিয়ে। কিন্তু এমন ভাবে থাকে যেসন্ধান না জানা থাকলে বোঝা অসম্ভব। সেই সময়কার
মনে থাকা কিছু ও ভাষার উদ্ধৃতিবলি... "তুমসি পতো হুমসি হামসির ঘরে
ঠিকছে" মানে তুমি পালাও লোকটি আমার ঘরে আসছে... "হুমসি হাম্সিকে
খুমুচিস্ করলো", মানে লোকটি আমাকে চুমু খেলো। খোবরা মানে মাংস, আর খিলুয়া
মানে মদ। সেখান থেকেই অনবদ্য একটি শব্দ জোগাড়করেছিলাম, বঙ্গলক্ষ্মী খিলুয়া, বাংলা
মদ। তো সেই বঙ্গলক্ষ্মী খিলুয়ার দিনগুলি ওইসঙ্গী সাথীদের সাথে অভুলনীয়। পাম
এভিনিউর পেছনেই বন্ডেল গেট। লেভেল ক্রসিং এরওপারেই ছিল বঙ্গলক্ষ্মী খিলুয়ার সরকারি
দোকান, আর তার সামনে সার দিয়ে চিপসের ছোটছোট ঢিপি। সামনে বিক্রি হতো লঙ্কা ছোলা,
ডিমভাজা, চানাচুর লেবু আর এরকম ঘোর গরমে স্বর্গীয় চাট নুন লঙ্কা মাখানো কাঁচা আম।
কেন জানিনা দোকানটা উঠে গেল। একসময়,একসময় কেন এখনো কলকাতায় বঙ্গলক্ষ্মীর প্রতিটি
আস্তানা চেনা। একেকটার একেক রকম ব্যক্তিত্ব, একেকরকম ঘ্রান স্বাদ।মনে পড়ে, তখন থাকতেম
নরেন্দ্রপুরে, কাছাকাছি রাজপুরে একটি বঙ্গলক্ষ্মী দোকান ছিল আশ্চর্য নিশ্চুপ,
শান্ত আর চতুর্দিকে ঘন নীল রঙের মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা। নিশ্চয়ইকোন গূহ্য কারন ছিল,
আমি বার করতে পারিনি, ওখানে খেতে খেতে কেউ একটু জোরে শব্দকরলেই পাশের রেগুলারগন
একসাথে বলে উঠতেন "চুপ, চুপ"। আমি অনেক মন্দিরেওই স্তব্ধতা পাইনি যা
রাজপুরের ওই দোকানে পেয়েছি। একটা শব্দ বলে এই বখে যাওয়াদুনিয়ার গল্প আপাতত শেষ করি
তা হলো তরোয়াল। তরোয়াল খুব চালু স্ল্যাং, যেকোন বাংলার দোকানে, ঠেকে প্রায়ই শুনতে
পাবেন, তরোয়াল। তরোয়াল মানে কি জানেন? মেয়েদের ঠোঁট। এই শব্দের স্রষ্টাকে আমি আমার
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
বহুক্ষন বখে যাওয়া দুনিয়ার আখ্যান
বলছিলাম। আমার আত্মীয় স্বজনের মনে একটা প্রবল প্রশ্নআছে, যার সামনা আমাকে প্রায়ই
করতে হয়, তা হলো এগুলো জেনে কি লাভ? সত্যি তো এগুলোজেনে কি লাভ কোনদিন ভেবেও
দেখিনি। সম্ভবতঃ লাভ ক্ষতির দুনিয়ার বাইরে এই সব জানাপড়া। আসলে আমি প্রাণপন
বিশ্বাস করি লেখক হতে গেলে প্রথমে স্বশিক্ষিত হতে হয়। প্রথাগত পড়াশোনার যে শেকল
আমরা না চাইলেও পরতে বাধ্য হই, তাকে নির্মম ভাবে ভাঙতেহয়। তারপর নিজেকে ডোবাতে হয়
স্বশিক্ষার সমুন্দরে। এখানে তুমিই শিক্ষক, তুমিই ছাত্র, তুমিই ঠিক করবে সিলেবাস,
তুমিই ঠিক করবে পাশ-ফেল। পৃথিবীতে শুধুমাত্রচোখকানমন খোলা রাখলে আর নিজের ভেতরে
এককোনে গুটিসুটি মেরে থাকা চুম্বকটিকে একটুস্নেহ ও আদর দিলে কতকিছুই যে শেখা হয়ে
যায় অজান্তে তার ইয়ত্তা নেই। আসলে আমরা অজান্তে অজান্তে বাঁচি, অজান্তে অজান্তে
বাঁচতে ভালোবাসি, এর থেকে সামান্য একটুপাশ ফিরলেই কত কি ভূভারত ঘটে যেতে পারে
মনের...
আসলে বাঙালীর ঐতিহ্য হচ্ছে বখে
যাওয়ার। বখে যাওয়ার অলিম্পিক হলে বাঙালী নিঃসন্দেহে তাতে গন্ডা গন্ডা সোনার মেডেল
জিতবে। সাহিত্যের ইতিহাসে সেই লুই, সরহ, কাহ্ন এরা সমাজেরচোখে বখে যাওয়া মানুষই
ছিলেন। স্বাধীনতার ইতিহাসে ক্ষুদিরাম। অথবা গুরুত্বপূর্ন স্ট্রিট হয়ে যাওয়া সূর্য
সেন। কতগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে নেমে পড়লেন ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধে। একে
বখে যাওয়া ছাড়া কি বলবেন? শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার সখেদে বলেছিলেন, এরা সেই
ন্যূনতম তথ্যটুকুও জানতোনা যে পৃথিবীর যেখানেযেখানেই অস্ত্রাগার আছে, সর্বত্র
বন্দুক যেখানে রাখা হয় গোলাবারুদ রাখা হয় তারথেকে আলাদা, অনেক দূরে। স্বাধীনতার
পরবর্তী বখে যাওয়ার ঐতিহ্য সপাটে বজায় রেখেছে সত্তর দশক। এখানে এসে মনে হতে পারে
আমি সেই চিরাচরিত নীরদসিগিরি বা বাঙালী বিদ্বেষের কথা বলছি। একেবারেই ভুল। আমি
চিরকাল এই বখে যাওয়ার ঐতিহ্যকে চরম সম্মান করে এসেছি। বখে যাওয়া না থাকলে, স্কুল
পালানো না থাকলে রবীন্দ্রনাথ হতোনা।তাই আমার ব্যাক্তিগত প্রতিটি বখে যাওয়ার সময়
পাশে পেয়েছি এঁদের, বখে যাবো কি যাবোনা এই সংশয় মনে জাগলে এঁদেরই সাহচর্যে হয়েছি
নিঃসংশয়। বখে যাওয়ার প্রসঙ্গ যখন এলোই, এ প্রসঙ্গে বাঙালীর গুপ্তকবিকে এড়াই কি
করে। ঈশ্বর গুপ্তের মতো বাঙালীর বখিয়া-যাওন এর ছবি আর কে এঁকেছে?
কবিতার নাম ইংরাজী নববর্ষ-
আয় লোভ চলযাই হোটেলের সপে।
এখনিদেখিতে পাবি কত মজা চপে।।
গড়াগড়িছড়াছড়ি কত শত কেক্।
যত পারোক'সে খাও টেক্ টেক্ টেক্।।
কারি ডিমআলুফিস ডিসপোরা কাছে।
পেট পূরেখাও লোভ যত সাধ আছে।।
#
যা থাকেকপালে ভাই টেবিলেতে খাব।
ডুবিয়াজবের টবে চ্যাপেলেতে যাব।।
কাঁটা ছুরিকাজ নাই কেটে যাবে বাবা।
দুই হাতেপেটভরে খাব থাবা থাবা।
পাতরেখাবনা ভাত গো টু হেল্ কাল।
হোটেলটোটেল নাশ সে বরম্ ভাল।।
পুরিবে সকলআশা ভেব না রে লোভ।
এখুনিসাহেব সেজে রাখিব না ক্ষোভ।।
আদি বানান হুবহু রাখা হলো। ইশ, খুব
ইচ্ছে করছে এর সাথে করা কমলকুমারের উডকাটগুলি যদি তুলে দিতে পারতাম। এ এক অমূল্য
নিধি। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সঙ্গে কমলকুমারের উডকাট। দাম?আধ আনা। ঈশ্বর গুপ্তের
আরেকটি অমূল্য কবিতা আছে, সেতার। সেখান থেকে সঙ্গীত জগতেরএক স্বল্পজানা ইতিহাস
পাওয়া যায়। বাঙালীর আরেক রবি, সদ্যপ্রয়াত, তাঁর বোলবলাও,প্রতিপত্তির কথা, বীটলস
ছাত্রের কথা সকলেরই জানা। কিন্তু এটা কি জানা, যে বেশী নয়মাত্র দেড়শো বছর পেছনে
গেলেই দেখতে পাব সেতার একটি উপহাসের বস্তু। আসলে এখন যতই জাকির, আমজাদ হোক,
যন্ত্রশিল্পীদের এই সেদিন অবধি ছোট চোখেই দেখা হতো। হীরুবাবু তবলিয়া বলেই উপেক্ষা
পেয়ে এসেছেন সারা জীবন। সেদিক দিয়ে সেতার যন্ত্র হিসেবেনিতান্তই অর্বাচীন। আদিতে
ছিল বীনা, যাকে হালকা করে করা হলো তানপুরা, সেটিকে আবারবহনযোগ্য করার জন্য
বিবর্তিত হয়ে হলো সেতার। তো সেতার, সারেঙ্গী বাদক, এরা ছিলেন নিম্নশ্রেণীর জীব,
মূলতঃ বাইজী সমাজে বাবুদের দ্বারা প্রতিপালিত। এর পূর্ণাঙ্গ উপাখ্যান নমস্য কীতাব বাবুকুমারপ্রসাদ রচিত,
"কুদরত রঙ্গি বিরঙ্গি"তে পেয়ে যাবেন। আমি বরং যেটা দূঃষ্প্রাপ্য, ঈশ্বর
গুপ্তের কবিতাটি সরবরাহ করি
সেতার
কোথায়সেতার তার কোথায় সেতার।
কোথায়সেতার কথা কি কহিব আর।।
সেতার অনেকআছে সে তার তঁ নাই।
সেতার-বাদকবিনা সে তার কি পাই।।
সেতার সেতার ছিল তারে তারে তার।
এখন সে তারলাগে কেবল বেতার।।
#
বেহালাবেহাল হয়ে ঘেরাটোপে কষা।
ভন্ ভন্স্বরে তায় রাগ ভাঁজে মশা।।
তান্পুরাআছে মাত্র তান পুরা নাই।
খরচ কেসাধে আর খরচ না পাই।।
যোয়ারিসোয়ার ছাড়া মরে অভিমানে।
এখন কে আছেফের ফের দেয় কানে।।
জোয়ারিরযোগে আর নাহি ক্ষরে মধু।
কাট বয়েকাট্ হয়ে ফেটে যায় কদু।।
অল্প আগে বলছিলুম না চোখকানমন খোলা
রাখলে কত কি যে শিখি তার কোন শেষ নেই। কোন বইতে আঁটে না।এবং এভাবেই আবিষ্কার হয়।
এই যেমন এক্ষুনি বকবকিং এর জন্য ইশ্বর গুপ্তের কবিতাটা টাইপ করতে করতে দেখলেম
গুপ্ত কবি ব্যবহার করেছেন "বেতার" শব্দটি, সন১৮৬০-৭০ কাছাকাছি। তখনো
কিন্তু আমাদের জগদীশ্চন্দ্র বা মার্কনি আসরে আসেননি। মানে বেতার আবিষ্কারের বহু
আগে ঈশ্বর গুপ্ত বেতার শব্দটি আবিষ্কার করে গেছেন। এবং এই তথ্যটির আবিষ্কারক আমি,
ঘটলোও আপনাদের সামনে। করতে জানলে, আবিষ্কার, সত্যিই খুবসহজ ও মজাদার।
এর জন্য শুধু প্রয়োজন চিন্তাভাবনার
পদ্ধতিকে ভার্টিক্যাল থিংকিং এর বদলে ল্যাটারেল থিংকিংএ পরিবর্তন করা। আমাদের
দৈনন্দিনের চিন্তা পদ্ধতি হচ্ছে ভার্টিক্যাল থিংকিং যার বেস হলো রক লজিক বা ধাপে
ধাপে যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে ঠিক করা। এই পদ্ধতিতে কোনকিছুকে দেখলে প্রথম প্রশ্ন জাগে
মনে "এটা কি?" তারপর যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে আমরাএকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছই যে
এটি চেয়ার, বা এটি প্রলয় বা এটি দড়াম। এতে আমরা অজান্তে নিজের চিন্তা ভাবনার ওপর
অনেক কন্ডিশন চাপিয়ে নি। ল্যাটারেল থিংকিং এ প্রথম প্রশ্ন জাগে "এটা কি হতে
পারে বা হোয়াট ইট ক্যান বি?" এটা গঙ্গাফড়িং ও হতে পারেআবার গঙ্গানদীও হতে
পারে। যেমন হবে আমার যুক্তি সেই আকৃতি নেবে, তাই এখানে যুক্তিকে হতে হয় ওয়াটার
লজিক। কবিতা বস্তুত ল্যাটারেল থিংকিং এরই বহিঃপ্রকাশ।কারোর অজান্তে, কারোর জানতে।
এই ল্যাটারেল থিংকিং রীতিমতো চর্চার বিষয় ও নিয়মিত রেওয়াজ দাবী করে। ল্যাটারেল
থিংকিং এর পদ্ধতিতে চিন্তা ভাবনা করলে এমন অনেক জিনিস বেরিয়ে আসে যা চোখের সামনেই
ছিল কিন্তু কখনো খেয়াল করিনি। তাই হয় আবিষ্কার। পরে কখনো এই চর্চার পদ্ধতি নিয়ে বড়
লেখার ইচ্ছে রইলো।
ল্যাটারেলথিংকিং এর সূত্রে আমার সদ্য
আবিষ্কৃত একটি অমূল্য কেতাবের কথা বলি শেষের দিকে এসে।বইটির নাম
"ভ্রান্তিবিনোদ", লেখক শ্রী কালীপ্রসন্ন ঘোষ যিনি পূর্ববঙ্গের
বিদ্যাসাগর নামে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। প্রকাশকাল ১৮৮১। ভ্রান্তি বিনোদ কালীপ্রসন্ন
ঘোষের কতগুলি নিবন্ধের সংকলন। আমি এই ২০১৩ তে বসে এই তুচ্ছ বকবকিং করছি আর
মূহ্যমান হয়ে তাকিয়ে আছি শ্রী ঘোষ ভায়ার নিবন্ধগুলির দিকে। একটি নিবন্ধের নাম
"প্রচলিত ও অপ্রচলিত মিথ্যাকথা"। লেখক লিখছেন "দিবা
দুপ্রহরে,সূর্যালোকে দণ্ডায়মান হইয়া, পরের বুকে ছুরি বসাও; তোমার নাম বীর। আর,
নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর একটি মিথ্যা কথা বলিয়া আপনার কি পরের কোন কার্য্য সাধন কর,
তোমার নাম নরাধম! সঙ্গত কি অসঙ্গত বুঝিনা, ইহাই শাস্ত্রের বিধি,- ইহাই সমাজেরসর্ব্ববাদিসম্মত
সাধারণ ব্যবস্থা, এবং এই ব্যবস্থার দৃঢ়তার উপরই বানিজ্য, ব্যবসায়,ভোগ, বিনিয়োগ,
আশ্বাস ও বিশ্বাস, দৌত্য ও বিচার এবং লোকের সহিত লোকের অশেষপ্রকারকার্য্যসম্বন্ধ ও
সামাজিকযন্ত্রের সর্ব্ববিধ ক্রিয়ার অবস্থান"... এই হচ্ছে পারফেক্ট ল্যাটারেল
থিংকিং এর উদাহরণ যা একেবারে গোড়ায় গিয়ে টান মারে আর সম্পূর্ন নতুন দেখার চোখ
বানায়। ঘোষ ভায়া বলে চলেছেন "কিন্তু লোকচরিত্র কি বিচিত্র!মিথ্যুকের এত
নিগ্রহ, এত লাঞ্ছনা সত্ত্বেও কতকগুলি মিথ্যা কথা সমাজে অদ্যাপি যারপর নাই
সমাদৃতভাবে প্রচলিত রহিয়াছে এবং সভ্যতা ও শিষ্টব্যবহার তাকে সকল স্থলেই অনুমোদন
করিয়াছে" এদেরকে ঘোষ মশাই নাম দিয়েছেন "প্রচলিত মিথ্যাকথা"। এবং
সেগুলি কি কি?
১।"ভালো আছি।- বিধাতা যে অবস্থায়
রাখুন না কেন, আমি ভালো আছি। সূর্য্যের উদয়হইতে সূর্য্যের পুনরুদয় পর্য্যন্ত সহস্র
স্থানে সহস্র লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইবে।সকলেই জিজ্ঞাসা করিবে 'ভালো আছো?' - উত্তর,
'ভালো আছি'। শরীর রোগে, শোকে ভস্ম হইয়া যাইতেছে, হৃদয় মনুষ্যলোচনের অদৃশ্য অনন্ত
যন্ত্রনায় বিদীর্ণ হইতেছে, মনুষ্য নিবাস গভীর তমসাচ্ছন্ন তরঙ্গসঙ্কুল সমুদ্রের
মূর্ত্তি ধারণ করিতেছে; আমি তথাপি ভালো আছি..."
বোঝাযাচ্ছে ১৮৮১ সালে চিন্তা ভাবনার
নতুনত্ব??!! কোথায় লাগে বকবকিং...
No comments:
Post a Comment